শুরুর গল্পে ডানা মেলে ছুটে চলা, অতঃপর অফ ফর্ম – ইনজুরি – অ্যাকশনে গড়মিল; উত্থানের গল্প লিখতে না লিখতেই ঘটেছিলো পতন। আট বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কত ঘটনারই না জন্ম দিয়েছেন, কান্নায় ভেঙে পড়া, অতঃপর উঠে দাঁড়ানো। পরিশ্রম, সাধনা আর অধ্যবসায়ে প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছেন নিজেকে, লিখছেন মহাকাব্য।
[১]
জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ; সেটিও বিশ্বমঞ্চে। মাশরাফির ইনজুরিতে সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত তাসকিন জানিয়েছিলেন “ওয়াটসন ও ম্যাক্সওয়েল” – এর উইকেট পকেটে পুড়তে চান। পহেলা এপ্রিলে বল হাতে তাসকিন তার কথা রেখেছিলেন, ওয়াটসনকে বল করার সুযোগ না হলেও ম্যাক্সওয়েলের স্ট্যাম্প ভেঙে মেলেছিলেন ডানা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডানা মেলে ছুটে চলার শুরুটা সেদিনই…
বিশ্বকাপে ঐ একটা ম্যাচেই সুযোগ হয়েছিলো, পরের সুযোগ এসেছিলো বঙ্গদেশেই, চেনা উইকেটে। নিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচেই পাঁচ উইকেট, প্রতিপক্ষ ভারত! সেদিন পাঁচ উইকেট নিয়ে তাসকিন চিনিয়েছিলেন নিজেকে, খুলেছিলেন স্বপ্ন পূরণের রাস্তা।
[২]
২০১৫ বিশ্বকাপ; মাত্র তিনটি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা। স্বপ্নবাজ তাসকিনের সুযোগ হয়েছিলো বিশ্বকাপের জার্সি গায়ে জড়ানোর। এদিক দিয়ে তাসকিন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতেই পারেন! কদিন আগেই টি-২০ বিশ্বকাপে অভিষেক, এবার ওয়ানডে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া, দুর্দান্তই বটে!
বিশ্বমঞ্চে সেবার বল হাতি রাঙিয়ে দিয়েছিলো তাসকিন। ম্যাশ-রুবেলকে ছাপিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার বনে যাওয়া, এটা কল্পনা করাও কঠিন! এরমাঝে অ্যাডিলেডে ইতিহাস রচনার দিনে বাটলারকে আউট করে যেনো ম্যাশকে সেরা ব্রেনথ্রুই এনে দিয়েছিলেন।
[৩]
২০১৬ তে ভারতে বিশ্বকাপ, দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠছিলেন তাসকিন। সময়টাও যে খারাপ যাচ্ছিলো এমনটাও না, কিন্তু হঠাৎই আইসিসি থেকে উঠেছিলো প্রশ্ন, বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ হলে দিতে হয় পরীক্ষা! এই যাত্রায় তাসকিন সফল হলেও হারিয়ে খুঁজতে থাকেন নিজেকে। উত্থানের গল্প বড় করার আগেই তাসকিন দেখেছিলো নিজের পতন। অ্যাকশন, অফ ফর্মের সাথে ইনজুরি; তাসকিন যেনো উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তিও পাচ্ছিলো না।
তবুও নিজেকে প্রমাণের নেশায় তাসকিন ছুটে চলেছিলো বাইশ গজে, ২০১৭ সালে ১৮ ম্যাচে ১৮ উইকেট শিকারের পর তাসকিন লাইম লাইটের আলো খুঁজে পাননি ২০১৮ সালে। পুরোনা ব্যথায় বিপিএলটাও খেলা হয়নি পুরোপুরি; এবার তাসকিন হারিয়েই গেলেন!
[৪]
অফ ফর্ম আর ইনজুরি কাটিয়ে বাইশ গজে তাসকিনের ফেরা, এবার জাতীয় দল নয়, বিপিএলে সিলেটের জার্সিতে দুর্দান্ত তাসকিন। গতির সাথে আগ্রাসন, ১২ ম্যাচে ১৪.৪৫ গড়ে ২২ উইকেট; বনে যান টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার। কয়েক মাস পরেই ব্রিটিশ মুলুকে বিশ্বকাপ; তাসকিন দেখেছিলেন নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন হয়নি পূরণ, বিশ্বকাপে জায়গা না পাওয়ার বেদনায় তাসকিন কেঁদেছিলেন, কাঁদিয়েছিলেন ভক্তদের।
আনফিটের দোহাই দিয়ে কান্নায় ভাসানো তাসকিনকে সেবারই দেখা গিয়েছিলো নতুন রূপে। এনসিএলে মাত্র ৪ ম্যাচে পকেটে পুড়েছিলেন ১৭ উইকেট! এখানেই শেষ হয়, পরিশ্রম আর সাধনায় ততোদিনে তাসকিন নিজেকে তৈরি করছিলেন নতুন রূপে, নতুন উদ্যোমে।
[৫]
কেটেছে অনেকটা পথ, ২০২১ সালে এসে তাসকিন আরও এবার স্বপ্নকে ছুঁয়েছেন, এবারের ছোঁয়া আলাদা, একদমই আলাদা…
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, লম্বাটে পায়ে ছুটে চলা অতঃপর দারুণ আগ্রাসনে তাসকিন যেনো ছুড়েছিলেন একেকটা বুলেট! ততোক্ষণে তাসকিন লিখতে শুরু করেছিলেন সাফল্যের গল্প। লঙ্কানদের বিপক্ষে সাদা পোশাকে তাসকিনের রঙিন শুরু। এরপর জিম্বাবুয়ের মাঠে নিজেকে আরও একবার করেছিলেন প্রমাণ! দারুণ গতিতে তাসকিন ততোদিনে পেয়ে গেছেন “স্পিড স্টার” তকমা! লাল-সবুজের দেশকে তাসকিন যেনো উড়তে শেখাচ্ছিলেন নতুন করে। বাংলাদেশে এমন আগ্রাসন আর গতির বোলার কি কখনো এসেছিলো? সেদিনের ম্যাশ কিংবা অ্যাডিলেডের হিরো রুবেলকেও ছাপিয়ে গেছিলেন তাসকিন, হয়ে উঠেছিলেন সকলের মধ্যমণি।
[৬]
তাসকিনের এমন সাফল্যের পিছনে কি ছিলো না? দিনরাত পরিশ্রম আর সাধনা, তীব্র রোদে বালির উপর ছুটে চলা, আবার কখনও বা আগুনের উপর হেঁটে চলা। নিজেকে ফিট রাখতে জিমনেসিয়ামে ঘাম ঝড়ানো। কি করেননি তাসকিন!
২০২২ সালে তাসকিন যেনো আরও ভয়ংকর! রঙিন কিংবা সাদা পোশাক; সবাইখানেই দুর্দান্ত পারফর্ম করে চলছেন,এগিয়ে যাচ্ছেন স্বপ্নের পানে। এর চেয়েও মুগ্ধ করছে তার আগ্রাসন ও গতি; সর্বশেষ আফ্রিকার ম্যাচে ১০ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৩ উইকেট শিকারী তাসকিন ডট দিয়েছেন ৪০ টি! নতুন বলে দলকে এনে দিয়েছেন সাফল্য, মিডল ওভারে দিনকে দিন অধিনায়কের আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠা তাসকিন আর ফিরতে চায়না অতীতে, এবার যে এগিয়ে যাওয়ার পালা। তাসকিন ঠিকই ছুটবে স্বপ্নের পানে, তাসকিনের মাঝে লুকিয়ে থাকা ক্ষুধা তো সেটিই বলে!

ছবির মতোই ছুটে চলুক তাসকিন; ছাড়িয়ে যাক নিজেকে! জন্মদিনে শুভেচ্ছা তাসকিন…
ফটো: Getty Images.