ক্রিকেটের উত্থান বেশ আগের, সাদা পোশাকে বাইশ গজে কতশত স্মৃতি! টানটান উত্তেজনা পূর্ণ ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। মুহূর্তেই বদলে যায় ম্যাচের ভাগ্য, যেখানে তৈরি হয় ইতিহাস। ক্রিকেটে কতো কিছুই না প্রথম ঘটে; যেখানে প্রথম সব ঘটনা রয়ে যায় স্পেশাল হিসেবে। তাই বলে, টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচেই বাইশ গজে ব্যাট হাতে চার্লস নিজেকে ইতিহাসের পাতায় প্রথম তিনের সাক্ষী করে রাখবেন সেটি হয়তো চার্লস নিজেও জানতো না। এমন কতো জানা-অজানার ভীড়ে রচিত হয়েছে ইতিহাস সেই সবই জানবো আজকের গল্পে।
• ১৫-ই মার্চ, ১৮৭৭
টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেক, আলফ্রেডের ছুটে আসা বলটি মোকাবিলা করতেই রেকর্ড বুকে চার্লস ব্যানারম্যান। কেননা টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বলটি মোকাবিলা করেছেন তিনিই! আর সেদিনই নিজেকে নিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়, প্রথম টেস্ট ফিফটি করেই ক্ষান্ত হননি, সেদিন ইংল্যান্ডের বোলারদের বিপক্ষে একা হাতে লড়াই করে তুলে নিয়েছিলেন সেঞ্চুরি, এতেও ইতিহাস। টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান কে এমন উত্তরে আসবে চার্লসের নামই। সেদিন ১৮ বাউন্ডারিতে খেলেছিলেন ১৬৫ রানের হার না মানা এক ইনিংস, এখানেও রেকর্ড! কোনো দলের মোট রানের ৫০% রান একা করা প্রথম ব্যাটার চার্লস। সেদিন দলের ৬৭% রান এসেছিলো চার্লসের ব্যাটে, হয়তো এটি আরও বাড়তে পারতো যদি না চোট পেয়ে অবসরে যাওয়া প্রথম ব্যাটার না বনে যেতেন!
• ১২ আগস্ট, ১৮৮৪
টেস্ট ক্রিকেটে ১৬ তম ম্যাচ, এর আগে দেড়শো রানের ইনিংস বিশ্ব দেখেছে মোটেই তিনবার। ১১-ই আগষ্ট, ১৮৮৪ সালেও টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান বছর সাতেক আগে খেলা সেই চার্লসের। ডাবল সেঞ্চুরির উদযাপন তখন দেখেনি বিশ্ব, অবশেষে ১২ আগষ্ট এসেছিলো সেই ঐতিহাসিক মূহুর্ত। ইংল্যান্ডের ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে বিলি মারডক মেতেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরির উদযাপনে, সেদিও অধিনায়ক হয়ে। টেস্ট ক্যারিয়ারে ২ সেঞ্চুরি পাওয়া মারডকের দু’টি ইনিংস ছিলো ১৫০+ রানের, অনবদ্য!
• ৩-ই এপ্রিল, ১৯৩০
মারডকের ডাবল সেঞ্চুরি হয়েছিলো প্রায় ৫৩ বছর আগে! এরপর কত রথীমহারথীর আগমন বাইশ গজে। এইসময়ে ওয়ালি হ্যামন্ড, জর্জ হ্যাডলি, জ্যাক হবসদের মতো ক্রিকেটার মাতিয়েছেন বাইশ গজ। কিন্তু কেউই সেই কাঙ্খিত ট্রিপল সেঞ্চুরির উদযাপনে মাততে পারেননি। এরমাঝে ইংল্যান্ডের আর. ই. ফস্টার ১৯০৩ সালে আশা দেখিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাকে থামতে হয়েছিলো ম্যাজিক ফিগার থেকে ১৩ রানে দূরে। এরপর প্রায় ২৭ বছর ফস্টার ছিলেন শীর্ষে, অতঃপর আরেক ব্রিটিশ অ্যান্ডি স্যান্ডহামের হাত ধরে ক্রিকেট বিশ্ব দেখে ফেলে ট্রিপল সেঞ্চুরির উদযাপন। এখানেও রয়েছে মজার কাহিনী, বিভিন্ন তথ্যমতে পাওয়া যায় স্যান্ডহাম সেই ইনিংস খেলেছিলেন অধিনায়কের ব্যাট এবং সতীর্থের জুতা ধার করে! গল্পটি শেষ হতে পারতো এখানেই, কিন্তু সেই ম্যাচে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে সাত নাম্বারে ব্যাটিংয়ে নেমে ফিফটি তুলে নিয়ে গড়েন আরেক ইতিহাস, যেটি অক্ষত ছিলো প্রায় ৪৪ বছর। রেকর্ডটি ছিলো এক ম্যাচে সর্বোচ্চ রানের !
• ১২ এপ্রিল, ২০০৪
প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরির পর কেটে গেছে প্রায় ৭৪ বছর, স্যান্ডহামের ইনিংসটি অবশ্য ত্রিশেই টপকে গেছিলেন ব্র্যাডম্যান। এরপর হ্যামন্ড, হাটন অতঃপর গ্যারি সোবার্সরা দখলে নিয়েছিলেন শীর্ষত্বের মুকুট। ৩৬৫ রানে হার না মানা সোবার্স হার মেনেছিলো ক্রিকেটের বরপুত্রের কাছে, সেটিও প্রায় ৪৪ বছর পর! ৩৭৫ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে লারা নিজেকে নিয়েছিলেন শীর্ষে, কিন্তু তখনও কোয়াড্রপল সেঞ্চুরির দেখা মেলেনি। এক ইনিংসে ৪০০ রান কোনো ব্যাটার করবে সেটি একটা সময় ছিলো কল্পনা! এরমাঝে লালার মাথায় শীর্ষত্বের মুকুট প্রায় ১০ বছর স্থায়ী ছিলো, ৩৮০ রান করে সেটি ভেঙে দিয়েছিলেন ম্যাথু হেইডেন। এবার যেনো লারা জেদ ধরে বসেছিলো, মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে লারা লিখে ফেলছিলেন মহাকাব্য।
সেন্ট জনস, অ্যান্টিগুয়ায় ১৬৯৬ তম টেস্ট ম্যাচ যে সব জল্পনা কল্পনার সমাপ্তি ঘটাবে সেটি কেউ না ভাবলেও লারা ভেবেছিলো হয়তো। ম্যাচে ১৩১ বলে সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া লারা মুগ্ধ করেছিলো নয়নাভিরাম ব্যাটিংয়ে! ফ্লিনটফ, বেটি, হগার্ড, হার্মিসনদের বিপক্ষে বাইজ গজে রূঢ়মূর্তি ধারণ করা লারা সময়ের সাথে সাথে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো নিজেকে। ব্যাট হাতে তাণ্ডব চালানো লারা কখনো পুল কখনোবা কাট শট; কাভার ড্রাইভ কিংবা ডাউন দ্য উইকেটে এসে বল সীমানার ওপারে আঁচড়ে ফেলা! ক্রিকেটের ব্যাকরণ মেনে দর্শকদের মাতিয়ে তোলা লারা দ্বিতীয় দিনে মাতেন ট্রিপল সেঞ্চুরির উদযাপনে। ৪০৪ বলে নিজের দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরির উদযাপনে মাতা লারা হয়তো সেদিন রানে ঘুমাতে পারেনি। পরেরদিন সকালে লাঞ্চের আগেই টপকে যান হেইডেনকে। লাঞ্চ ব্রেকের পর লালা গড়েন ইতিহাস, টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ও একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে মাতেন কোয়াড্রপল সেঞ্চুরির উদযাপনে। কখনো আকাশ পানে মুঠো হাত ঘুরিয়ে কখনো বা দু’হাত তুলে উদযাপন, একটা সময় চুমু খেলেন সেই পিচে; যেই পিচে তিনি গড়েছেন ইতিহাস।
এরপর কেটে গেছে প্রায় দেড় যুগ, বিশ্ব ১২ টি ট্রিপল সেঞ্চুরির দেখা পেলেও কোয়াড্রপল সেঞ্চুরির দেখা পাননি আর। এরমাঝে মাহেলা জয়াবর্ধনে আশা জাগিয়ে ফিরেছিলেন মাত্র ২৬ রান দূরে থেকে। এবার আরেকটু পেছনে ফিরলে চারশো রানের ইনিংসের দেখা মিলবে বেশকিছু, যেখানে এক ইনিংসে ৫০০ রানও দেখেছে বিশ্ব! সেটিও এই লারার হাত ধরেই; সবকিছুই ঘরোয়া ক্রিকেটে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে লারার আগে ইনিংসে চারশো রানের মাইলফলক স্পর্শের ঘটনা ঘটেছে আট বার। ক্রিকেটের উৎপত্তির পর কতশত রেকর্ড; শচীনের ২০০ টেস্ট কিংবা ডনের সর্বোচ্চ গড়! কিন্তু কেউ-ই টপকাতে পারেনি লারাকে। ক্রিকেটের বরপুত্র খ্যাত লারা ১৫০ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র ব্যাটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইনিংসে ৪০০ ও প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করা একমাত্র ব্যাটার।
স্যালুট, ব্রায়ান চার্লস লারা।