(Photo by Patrick Eagar/Popperfoto via Getty Images/Getty Images)
শচীন-লারাদের ভীড়েও যিনি নিজেকে চিনিয়েছিলেন, বনে গেছিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের প্রতীক। রিভার্স কিংবা স্লগ সুইপকে যিনি চিনিয়েছিলেন নতুন করে, সেই তিনি আধুনিক উইকেট-কিপার ব্যাটসম্যানের মূল বিপ্লব ঘটানোর কারিগরও। ক্যাম্পবেল, গুডউইন, স্টুয়ার্ট, স্ট্রিক কিংবা ওলোঙ্গা-জনসন; জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইতিহাস ঘাটতে গেলে আপনি এই নামগুলোর সাথে আরেকটি নাম পাবেন যিনি জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটকে চিনিয়েছিলেন বিশ্ব দরবারে, তিনি অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, দ্য কিং অব রিভার্স সুইপ!
উইকেটরক্ষক ব্যাটারের কথা আসলে ফ্লাওয়ার অন্যতম সেরা, কারও কাছে তো সেরাই বনে গেছেন। উইকেটরক্ষক শব্দটি বাদ দিলেও তার সময়কালে ছিলেন অন্যতম সেরা ব্যাটারও! পরিসংখ্যান বলে ফ্লাওয়ার তার সময়কালে সর্বনিম্ন ৪৫০০ রান করা ব্যাটারদের মাঝে গড়ের দিক দিয়ে ছিলেন চতুর্থ স্থানে! তার উপরে ছিলেন শচীন-দ্রাবিড়রা! পিছনে ছিলেন গাঙ্গুলি, সাঙ্গাকারা, লারার মতো ব্যাটাররা! অবশ্য রান কিংবা ম্যাচের দিক দিয়ে লারা এগিয়ে ছিলেন বেশ।
নব্বই দশকের শেষ দিকে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে উত্থানের গল্প রচিত হয়েছিলো বেশ! সেই সময়ে ফ্লাওয়ার যেনো হয়ে উঠেছিলেন সতীর্থদের মধ্যমণি। শুধু জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটেই নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেও ছড়িয়ে পড়েছিলো তার নাম। উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে ৫৫ টেস্টে রান করেছিলেন ৫৩.৭০ গড়ে। বাকি ৮ টেস্টে ব্যাটিং গড় ৩৫.৪৫। এইসবের সাথে দুই ফরম্যাট মিলিয়ে ৩৩৩ টি ডিসমিসাল! কিংবদন্তি হতে এটাই কি যথেষ্ট নয়?
আরেকটা তথ্যে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের পজিশন ছিলো সবার উপরে, তার সময়কালে তিনিই ছিলেন একমাত্র উইকেটরক্ষক ব্যাটার যিনি চার হাজার রানের সাথে ব্যাটিং গড়টিও রেখেছিলেন ৫০+! এখানেই শেষ নয়, ১২ টি সেঞ্চুরি করে ছিলেন শীর্ষে। তার চেয়ে বেশী ম্যাচ খেলে অ্যালেক স্টুয়ার্ট(৬৭), ইয়ান হিলি(৮০) সহ বাউচার, প্যারোরেরা ছিলেন বেশ পিছিয়ে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬ টি সেঞ্চুরি করেছিলেন স্টুয়ার্ট ও গিলক্রিস্ট! টেষ্ট ক্রিকেট ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে অ্যান্ডির চেয়ে রানের দিক দিয়ে এগিয়ে মাত্র চারজন, সেঞ্চুরির দিক দিয়ে মাত্র একজন, সেটি গিলক্রিস্ট!!
আধুনিক ক্রিকেটে উইকেটরক্ষক ব্যাটাররা যেনো কিপিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও এগিয়ে চলছে সমান তালে! হালের ঋষভ পন্ত, বিজে ওয়াটলিং, বাটলার কিংবা লিটন দাস সবাই চেষ্টা করে চলছে ব্যাটার হিসেবে অবদান রাখার। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে সর্বনিম্ন ৪ হাজার রান করা উইকেটরক্ষক ব্যাটারদের মাঝে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের! আরেকটু নিচে তথা ২ হাজার রানের হিসেবে দেখতে গেলে অ্যান্ডির উপরে আছে শুধুই এবিডি ভিলিয়ার্স!
টেস্ট ক্রিকেটের শুরু থেকে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আসার আগ অব্দি উইকেটরক্ষক ব্যাটারদের মাঝে সর্বোচ্চ রান ছিলো ইংল্যান্ডের অ্যালান নটের(৪৩৮৯)! এছাড়াও সর্বনিম্ন ২ হাজার রান করেছিলো এমন ব্যাটারদের মাঝে সর্বোচ্চ গড় ছিলো আরেক ইংরেজ উইকেটরক্ষক ব্যাটার লেস অ্যামিসের(৪৩.৪০)। অ্যান্ডির সময়ে সেটি ছিলো অ্যান্ডির দখলেই। অ্যান্ডি পরবর্তী সময়ে উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে বিশ্ব মাতিয়েছেন ধোনি, মুশফিক, বাউচার, গিলক্রিস্ট, ম্যাককুলামের মতো ব্যাটার। সাম্প্রতিক সময়ে ঋষভ পন্ত, লিটন, রিজওয়ান, বাটলারের মতো ক্রিকেটারের দেখা মিললেও অ্যান্ডিকে ছুঁতে পারেনি কেউই! এই সময়ে রানের দিক দিয়ে ধোনি(৪৮৭৬) শীর্ষে থাকলেও সর্বনিম্ন ২ হাজার রান করা উইকেটরক্ষক ব্যাটারদের মাঝে সর্বোচ্চ ৫৭.৪১ গড় নিয়ে শীর্ষে আছেন এবিডি ভিলিয়ার্স।
সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটার কে সেটি নিয়ে গিলক্রিস্টের সাথে অ্যান্ডির একটা লড়াই চলতেই পারে! কিন্তু শুধুমাত্র কিপার হিসেবে গিলক্রিস্ট অ্যান্ডির থেকে বেশ এগিয়ে। উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে একটি জায়গায় অ্যান্ডি জায়গা করে নিয়েছে সবার উপরে। নির্দিষ্ট কোনো ক্যালেন্ডার ইয়ারে একমাত্র উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে হাজার রানের রেকর্ড শুধুই অ্যান্ডির। ২০০০ সালে মাত্র ১৬ ইনিংসে ৮০.৩৮ গড়ে ১০৪৫ রান করেন অ্যান্ডি। উক্ত বছরে অ্যান্ডির চেয়ে মাত্র ৪৫ রানে এগিয়ে থেকে শীর্ষে ছিলেন পাকিস্তানের ইনজামাম-উল-হক।
এবার একটু জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে ফেরা যাক! নব্বই দশকের শেষ দিকে বিশ্ব ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ে যেনো মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছিলো। ঠিক সেই সময় জিম্বাবুয়ের জার্সিতে বিশ্ব মাতাতেন দুই ভাই, অ্যান্ডি ও গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার! তাদের দুইভাইয়ের হাত ধরে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট কতোটা এগিয়ে সেটি সেই সময়ের ক্রিকেট বিশ্লেষকরাই ভালো ব্যখ্যা দিতে পারবে। এই দুই ভাইয়ের যুগলবন্দীতে রয়েছে বেশকিছু রেকর্ড, এরমাঝে পাকিস্তানের বিপক্ষে গ্র্যান্টের অসাধারণ এক ইনিংসে জয় পাওয়ার ম্যাচে অ্যান্ডিকে সাথে নিয়ে ২৬৯ রানের জুটি গড়ে ‘চ্যাপেল ভাইদের’ আগের সর্বোচ্চ রানের জুটি ভেঙে গড়েন নতুন রেকর্ড! যেই রেকর্ডের ম্যাচে পাকিস্তানকে ইনিংস ব্যবধানে হারানোর স্বাদ পায় জিম্বাবুয়ে।
রঙিন পোশাকেও অ্যান্ডি ছিলেন না পিছিয়ে! নিজের অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করে জানান দিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে অনেককিছু দেওয়ার আছে তার! ক্যারিয়ার শেষে দিয়েছেনও, নামের পাশে যুক্ত করেছেন ৩৫ গড়ে ৬৭৮৬ রান। এখানে কিপার হিসেবে ৩৪ গড়ে ৫৮৪৫ রান করে তালিকায় আছেন পঞ্চম স্থানে। অ্যান্ডি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪ টি সেঞ্চুরি পেয়েছেন উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে।
অ্যান্ডি তার অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচটি খেলেছিলেন বিশ্বকাপে, সেদিন দল হারলেও জিতেছিলেন ম্যাচ সেরার পুরষ্কার! এরপর আরও দু’টি বিশ্বকাপে দেখা মিলেছিলো অ্যান্ডির। সবমিলিয়ে ২৯ ম্যাচে ৩২.৬০ গড়ে অ্যান্ডি করেছিলেন ৮১৫ রান। অ্যান্ডি যে বড় মাপের একজন ব্যাটার ছিলেন তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে অ্যান্ডির সময়ে বাঘা বাঘা বোলারদের আগমন ঘটলেও ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে ছিলেন দুর্দান্ত।
ঐ যে বললাম সেরা বোলারদের বিপক্ষে দারুণ ছিলেন অ্যান্ডি, সেটির প্রমাণ মিলেছিলো তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই। ৯৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে খেলেছিলেন ১৫৬ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। ওয়াসিম আকরাম ও আকিব জাভেদের মতো পেসারদের বিপক্ষে অ্যান্ডির এমন ব্যাটিং কতোটা মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলো সেটি সেই সময়ের ক্রিকেটপ্রেমীরাই ভালো বলতে পারবে। এই সেই ম্যাচ, যেই ম্যাচে গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারও মেতেছিলো রান উৎসবে! দুই ভাই মিলিয়ে লিখেছিলেন ইতিহাস। অ্যান্ডি অধিনায়ক হিসেবে প্রথম টেস্ট জয়টাও করেছিলো সেই ম্যাচে।
অ্যান্ডি তার প্রায় এক যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় কাটিয়েছেন ২০০০-২০০১ সাল অব্দি। এই দুই বছরের পারফরম্যান্স অ্যান্ডিকে নিয়েছিলো অনন্য উচ্চতায়, সেরাদের কাতারে। টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে ২০০০ সালে ৪৬.২৩ গড়ে ১৯৮৮ ও ২০০১ সালে ৪৮.৯৭ গড়ে করেন ১৯৫৯ রান! মজার বিষয় হলো এই দুই বছর দু’টি ভিন্ন গল্পের জন্ম দিয়েছিলেন। ২০০০ সালে করেন টেস্ট ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ স্কোর আর ২০০১ সালে সাদা পোশাকে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন ১৯৯ রানে! আহ কি বেদনাদায়ক স্মৃতি!
অ্যান্ডির আমলে জিম্বাবুয়ে বড় বড় দলের দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেয়েছিলো বেশ। অ্যান্ডিও দু’হাতে লুফে নিয়েছিলেন সুযোগগুলো। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দলের বিপক্ষে সেই সময় অ্যান্ডি চালিয়েছিলে ব্যাটিং তাণ্ডব। দুই ফরম্যাট মিলিয়ে ১৫০০+ করেছেন ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে! আফ্রিকা, ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষেও অ্যান্ডির পারফরম্যান্স ছিলো চোখে পড়ার মতো।
অ্যান্ডির প্রিয় প্রতিপক্ষ কে? উত্তরে আপনি যেই নামটি খুঁজে পাবেন তাতে অবাক হতেই পারেন। পরিসংখ্যান বলে ভারত ছিলো অ্যান্ডির প্রিয় প্রতিপক্ষ, যেই দলের বিপক্ষে ৫৩ ইনিংসে ৫৫.৩৬ গড়ে করেছেন ২৪৩৬ রান। এখানেও একটা রেকর্ডে সাক্ষী হয়ে আছেন তিনি, সেটি অবশ্য সাদা পোশাকের ম্যাচে। যেই ফরম্যাটে ভারতের বিপক্ষে অ্যান্ডির গড় ছিলো ৯৪.৮৩!
উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে অ্যান্ডি যেনো ব্যাট হাতে ধারণ করেছিলেন রূঢ়মূর্তি। যেখানে ভারতের স্পিনারদের বিপক্ষে ক্রিজে টেকে থাকা কঠিন সেখানে চার ইনিংসে অ্যান্ডির রান ছিলো ১৮৩, ৭০, ৫৫, ২৩২! এতেই গড়েছিলেন ইতিহাস, দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে অ্যান্ডির চেয়ে বেশী রান করতে পারেনি কেউই!
শুরুতেই বলেছিলাম শুধুমাত্র ব্যাটার হিসেবেও অ্যান্ডি সেরাদের কাতারে থাকতে বাধ্য! সেটি প্রমাণ করেছিলেন অ্যান্ডি নিজেই। টেস্টে যেকোনো ব্যাটারের একটানা সর্বোচ্চ ফিফটি রয়েছে ৭ টি। আপনি অবাক হলেও সত্য এটাই, অ্যান্ডি এই তালিকায় যৌথভাবে আছেন শীর্ষে। এছাড়াও ভারতের বিপক্ষে টানা ৬ ইনিংসে ৫০+ ও ৮ ইনিংসে ৪০+ রানের ইনিংস উপহার দেওয়া অ্যান্ডিকে সেরা ব্যাটারদের তালিকায় দেখলে অবাক হবার কিছুই নেই।
অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ছিলেন জিম্বাবুয়ের ব্যাটিংয়ের প্রাণ! একজন উইকেটরক্ষক হয়েও ব্যাট হাতে দলকে রক্ষা করে গেছেন নিয়মিত। ১৯৯৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শূন্য রানে ৩ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়েকে এনে দিয়েছিলেন লড়াকু পুঁজি। ভারতের বিপক্ষে ২৩২ কিংবা আফ্রিকার বিপক্ষে হৃদয়বিদারক ১৯৯ রানের অপরাজিত ইনিংস! উইকেটের পিছনে গ্লাভস হাতে ১০৭.৪৬২৪ গড়ে প্রতি ইনিংসে ১.৫৭২ টি ডিসমিসাল করা অ্যান্ডি যে আস্ত একটা কিংবদন্তি।।
২৩২ রানের ইনিংসটি শুধুমাত্র অ্যান্ডির ক্যারিয়ারের সেরা স্কোর নয়, টেস্টে উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস হিসেবে এখনো রয়েছে অক্ষত! এছাড়াও আরও একটি জায়গায় অ্যান্ডি প্রমাণ করেছেন তিনি একজন কিংবদন্তিই! টেস্টে উইকেটরক্ষক + অধিনায়ক; এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা কম নয়, যেখানে অ্যান্ডি তৃতীয় সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক! সবমিলিয়ে অ্যান্ডিকে কি সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটার বলা যায়না?
প্রায় এক যুগের ক্যারিয়ারে কতশত স্মৃতির জন্ম দিয়েছেন অ্যান্ডি! অভিষেকে সেঞ্চুরি, উইকেটরক্ষক হিসেবে সর্বোচ্চ স্কোর কিংবা ৯৯* ও ১৯৯* রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়ার দু’টি হৃদয়বিদারক স্মৃতি। পিছিয়ে ছিলেন না টানা ম্যাচ খেলে যাওয়ার রেকর্ডেও। উত্থান – পতনের গল্পে অ্যান্ডির সাফল্যের গল্পগুলোই বড় করে দেখা উচিত। তবে কিছু বিতর্ক অ্যান্ডিকে মনে করিয়ে দেয় নতুন করে। ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে এসে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন অ্যান্ডি, সেটিও বিশ্বকাপ শুরুর মাস খানেক আগে, সঙ্গী হেনরি ওলোঙ্গা। সেবার অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা এক শ্বেতাঙ্গ ও এক কৃষ্ণাঙ্গ জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটার যারা মাঠে দেখিয়েছিলেন এক অন্যরকমের প্রতিবাদ। দু’টি দুইটা আর্মব্যান্ডের সাথে একটা কড়া বিবৃতি। যেটির জন্য বিশ্বকাপও শেষ হতে পারতো। সেই বিবৃতি ছিলো, “আমরা এর মাধ্যমে শোক প্রকাশ করছি, আমাদের প্রিয় জিম্বাবুয়ের গণতন্ত্রের মৃত্যুর। আমরা এমন করছি জিম্বাবুয়েতে মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ণকারীদের কাছে একটা নীরব আবেদন করতে। আমরা প্রার্থনা করি, আমাদের এ ক্ষুদ্র পদক্ষেপ আমাদের জাতির মতৈক্য ও মর্যাদা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে।”
সেদিন নানান তর্ক-বিতর্কের জন্ম হয়, অ্যান্ডির দল থেকে বাদ পড়ার গুঞ্জনও উঠেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অ্যান্ডি ২০০৩ বিশ্বকাপ মাতিয়েছিলেন। অ্যান্ডির শেষটা রঙিন না হলেও সেবার জিম্বাবুয়ে উঠেছিলো সুপার সিক্সে। সেই বিশ্বকাপেই নিজের শেষ ম্যাচ খেলা অ্যান্ডিকে আর কখনো দেখা যায়নি জাতীয় দলের জার্সিতে গ্লাভস কিংবা ব্যাট হাতে উদযাপনে মাততে। ততোদিনে অ্যান্ডি নিজেকে সাজিয়েছেন নিজের মতো করে, নিজের নামটি লিখেছিলেন কিংবদন্তিদের কাতারে।
ক্রিকেটকে বিদায় বললেও ছাড়তে পারেননি ক্রিকেটের মায়া। ব্যাট-কিপিং গ্লাভস হাতে বিশ্ব মাতানো অ্যান্ডি পরবর্তী সময়ে যুক্ত হোন কোচিংয়ে। জন্মভূমি ইংল্যান্ড জাতীয় দলের প্রধান কোচের ভূমিকায় থেকে সাক্ষী হয়ে আছেন অনেক স্মৃতির। অ্যান্ডির অধীনে ২৪ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ জয় করে ব্রিটিশরা। এখানেই শেষ নয়, সাদা পোশাকে ইংল্যান্ডকে র্যাংকিংয়ে শীর্ষে নিয়েছিলেন অ্যান্ডি। অ্যান্ডির হাত ধরে ইংল্যান্ড পূরণ করে শূন্য স্থান, সেটিও টি-২০ বিশ্বকাপ জয় করে। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডকে বিদায় জানান তিনি।
শেষ থেকে শুরুতে ফেরা যাক! ১৯৬৮ সালের আজকের দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে জন্ম গ্রহন করেন অ্যান্ডি। জন্ম আফ্রিকায় হলেও পাড়ি জমান জিম্বাবুয়েতে। সেখানে ক্রিকেটের সাথে বেড়ে ওঠা, অতঃপর স্কুল ক্রিকেটে দ্রুতি ছড়িয়ে নজর কাড়া। বিভিন্ন তথ্যে জানতে পারলাম, স্কুল ক্রিকেট কিংবা বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে অ্যান্ডিকে আউট করাই ছিলো বিপক্ষের বোলারদের কাছে একটা স্বপ্ন, কেননা অ্যান্ডিকে আউট করতে পারতো খুব কম ম্যাচেই। স্বাভাবিকভাবেই অ্যান্ডি তকমা পেয়েছিলেন “নট আউট”! পরবর্তী সময়ে এটির প্রমাণও রেখেছেন অ্যান্ডি, সেটিও ঘরোয়া ক্রিকেটে। লিস্ট এ ও প্রথম শ্রেনীর ম্যাচ মিলিয়ে অ্যান্ডি অপরাজিত থেকে মাঠ ছেড়েছেন ঠিক ১১৪ ইনিংস!
গল্পের তালে ভুলেই গেছিলাম একটা পরিসংখ্যান দিতে। ক্রিকেটে হোম ও অ্যাওয়ে বলে দু’টি শব্দের বেশ প্রচলন রয়েছে। বিশ্বের অনেক বাঘা বাঘা ব্যাটাররা ঘরের মাঠে সফলতা পেলেও বিপক্ষের মাটিতে ছিলেন সাদামাটা। এদের মাঝে খুব কম সংখ্যক ক্রিকেটার আছেন যারা হোম ও অ্যাওয়ে দুই জায়গায় ছিলেন দুর্দান্ত! অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারও তাই! পরিসংখ্যান এমন ছিলো যে সাদা পোশাকে অ্যান্ডিকে ঘরের মাঠ আর প্রতিপক্ষের মাঠ আলাদা করাই ছিল দুষ্কর ব্যপার। কেননা, ঘরের মাঠে ৫১.৮১ গড়ে রান করা অ্যান্ডি প্রতিপক্ষের মাঠে রান করেছেন ঠিক ৫১.২৬ গড়ে! এবার আপনিই বলুন, অ্যান্ডিকে আলাদা করে দেখার উপায় আছে কি!
অ্যান্ডির প্রিয় শট কোনটি? উত্তরে জানতে পারলাম অ্যান্ডি যখন ব্যাটিংয়ে নামতেন তখন ক্যামেরাম্যানরা রিভার্স সুইপ কিংবা স্লগ সুইপের দৃশ্য ধারণ করতে তৈরি হয়ে যেতেন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অ্যান্ডির মতো নিখুঁতভাবে রিভার্স সুইপ খেলতে পারতো না আর কোনো ব্যাটার। তাইতো অনেকে অ্যান্ডিকে “কিং অব রিভার্স সুইপ” নামেও অ্যখ্যা দিয়ে থাকেন।
অ্যান্ডি জাতীয় দলকে বিদায় বলার পর জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটও যেনো সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি আর। মাঝে মাসাকাদজা, উইলিয়ামস, টেইলররা হাল ধরার চেষ্টা করলেও জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট লিখতে পারেনি উত্থানের গল্প। পরবর্তী সময়ে রাজা এসে তাদের অলরাউন্ডারের অভাব পূরণ করার চেষ্টা চলাচ্ছেন। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে অনেক রথী মহারথীদের আগমন ঘটেছে কিংবা সামনেও ঘটবে, কিন্তু একজন অ্যান্ডির অভাব কখনও পূরণ করতে পারবে কি না এটা নিয়ে ঘোর সংশয় থাকতেই পারে। অবশ্য, অ্যান্ডির উত্তরসূরি হিসেবে টেইলরও নিজেকে প্রমাণ করেছেন অনেকটা। কিন্তু অ্যান্ডি ছিলেন অনন্য!
সেরা কিংবা অন্যতম সেরার হিসেব কষতে গেলে শুরু হবে তর্ক-বিতর্ক! কারও মতে অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটার অ্যান্ডি আবার কারও কাছে গিলক্রিস্ট। সবমিলিয়ে তাদের মাঝের দূরত্ব কতোটা সেটি বের করা কঠিন। অ্যান্ডির জন্মদিনে সেই উত্তরে না গেলেও আধুনিক ক্রিকেটে উইকেটরক্ষক ব্যাটারদের মূল বিপ্লব ঘটানো অ্যান্ডিকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
শুভ জন্মদিন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার!