তার সময়ে তো বটেই, কারও মতে ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ওপেনারদের মাঝে অন্যতম সেরা! ধ্রুপদী ব্যাটিং টেকনিকের সাথে ফ্ল্যামবয়েন্ট স্ট্রোকপ্লে; সাথে আগ্রাসন, অন্যতম সেরা বিধ্বংসী ওপেনার বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয় কারও। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের সোনীল অধ্যায়ে যার নামটি রয়েছে বড় অক্ষরে, তিনি তো রয়েছেন ক্রিকেটীয় রূপকথার বিশাল অংশ জুড়ে।
বাউন্সি উইকেট, দ্রুতগতির ছুটে আসা বল কিংবা দারুণ সব সুইং; পেস বোলারদের বিপক্ষে কি দারুণ ভাবে সামলিয়েছেন নিজেকে। কখনও হুক আবার কখনও বা পুল শটে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন বাইশ গজে। দ্রুতগতিতে ছুটে আসা বাউন্সারে পায়ের ব্যবহার করে পুল ও হুক শটের মতো করে খেলা শটটির জন্য গ্রিনিজ মনে থাকবেন কোটি ভক্তের হৃদয়মাঝে। নতুন বলের সুইংগুলো সামলিয়েছেন দারুণ দক্ষতায়; বলের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সোজা ব্যাটে স্ট্রেট-ড্রাইভ কিংবা বাউন্সারে ট্রেডমার্ক শট ‘ওয়ান লেইড পুলে’র সাথে স্কয়ার কাটে তার পারদর্শীতা জানান দেয় স্কিল, সামর্থ ও টেকনিকের।
ক্যারিবিয়ান ও আগ্রাসন যেনো একে অপরের পরিপূরক! আক্রমণ যেনো তাদের সাফল্যের মূলকেন্দ্র। কিন্তু এক্ষেত্রেও যে দরকার টেকনিক কিংবা প্লেসমেন্টের, শট সিলেকশন তো মূলকেন্দ্র। এখানেও গ্রিনিজ সেরা, অনবদ্য। গ্রিনিজ মনে করতেন আগ্রাসনও উদ্দেশ্যমূলক হওয়া উচিত। এই বিষয়ে তিনি বলেন – “Strokeplay should be purposeful. If you’re going to hit the ball, hit it.” গ্রিনিজ যদি মনে করতেন তাহলে তিনি সেই বলটিতে হিট না করে থামতেন না। দারুণ দক্ষতায় উইকেটের চারপাশে হাঁকানো তার স্ট্রেইট – কভার কিংবা স্কয়ার ড্রাইভগুলো সেটিই বটে। আহ; কি দুর্দান্ত প্লেসমেন্ট আর হিটিং এবিলিটি! আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। গ্রিনিজ বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম নিখুঁত ও ক্লিন হিটার হিসেবেও পরিচিত!
ঐ যে বললাম আগ্রাসনের সাথে ক্যারিবিয়ানরা একে অপরের পরিপূরক। গ্রিনিজের সময়কালেও সেটির প্রভাব লক্ষ্যনীয়। গ্রিনিজের সময়কালে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ছক্কা হাঁকানো তিন ব্যাটারের দু’জনই ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ভিভ ও গ্রিনিজের সাথে বাকি নামটি ব্রিটিশ বোথামের। এখানে গ্রিনিজ নতুন বলে এতোটাই সাবলীল ছিলেন যে তার ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ হয়েছিলো অনেকেই। পেসারদের বিপক্ষে শুরু থেকেই ডোমিনেট করে খেলা গ্রিনিজের ব্যাটিং স্টাইলকে বলা হয় ইংরেজ রক্ষণের সাথে ক্যারিবীয় আগ্রাসনের এক অদ্ভুত যুগলবন্দী। এই বিষয়ে উইজডেন বলেছিলো – “He was a superb technician, who learned solid defensive techniques on the pudding pitches of his childhood in England and then allied them to an uninhibited Caribbean heritage.”
ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে তাকালে টেকনিক্যালি নিখুঁত ব্যাটারের দেখা মিলে খুবই কম। এদের আগ্রাসন বিশ্বের যেকোনো দেশের ব্যাটারদের চেয়ে আলাদা হলেও গ্রিনিজ এদিক দিয়ে ছিলেন আলাদা। আর সেটি সম্ভব হয়েছে ইংল্যান্ডে বেড়ে উঠার ফলেই। কম্প্যাক্ট ও রক সলিড ডিফেন্স আয়ত্ত করেছিলেন ইংল্যান্ডেই, একজন আদর্শ ওপেনারের ক্ষেত্রে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিনিজ টেকনিক্যালি সলিড ওপেনার হলেও ব্যাটিং আদর্শ মানতেন আরেক ক্যারিবিয়ান রড ফ্রেডেরিকসনকে। যার ব্যাটিং দেখে বড় হয়েছেন, শিখেছেন আগ্রাসন ব্যাটিং! এই বিষয়টি জানিয়েছেন খোদ গ্রিনিজই। আদর্শমানা রডকে নিয়ে গ্রিনিজ বলেন – “রয় একজন ড্যাশিং খেলোয়াড় ছিলেন, প্রায় প্রতিটি বলেই তিনি একটি স্ট্রোক খেলতেন। তিনি খুব সাহসী ছিলেন। কে বোলিং করছে, কত দ্রুত, সেগুলো বিবেচ্য নয়। আমি তার ব্যাটিং স্ট্রাইলগুলো মুগ্ধ হয়ে শিখছিলাম, যা আমাকে অনেক এগিয়ে নিয়েছে।”
গ্রিনিজ তার সময়ে অন্যতম সেরা আগ্রাসনী ব্যাটার তো ছিলেনই! এমনকি বিশ্বের অন্যতম সেরা আগ্রাসনী ওপেনারও। তার সময়ে ওপেনারদের মাঝে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। গ্রিনিজের উপরে ছিলেন শুধুই ভারতের গাভাস্কার। তার পিছনে ছিলেন গুচ, বয়কট, মার্শের মতো ওপেনার। সবমিলিয়ে তৎকালীন সময়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় গ্রিনিজ ছিলেন ষষ্ঠ স্থানে! ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে তার উপরে ছিলেন শুধুই ভিভ। এছাড়াও টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে ডানহাতি ওপেনারদের মাঝে সেরা পাঁচ রান সংগ্রাহকের একজন গ্রিনিজ। তবুও কি গাভাস্কার, শেবাগ, বয়কটদের মতো গ্রিনিজ নিজেকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করতে পেরেছে? হয়তো বা!
ক্রিকেট জুটির খেলা, যেখানে বাইশ গজে জুটি গড়ে স্মৃতির পাতায় নিজেদের নামটি লিখেছেন স্বর্নাক্ষরে। শচীন-দ্রাবিড় কিংবা জয়াবর্ধনে-সাঙ্গা জুটিরও সুনাম রয়েছে বেশ। পন্টিং- হেইডেন যেমন নিজেদের জুটিকে নিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। এদের সাথে একটি জুটি ছাড়িয়ে গিয়েছিলো সবাইকে। সেটিও ওপেনিং পজিশনে। যেখানে নতুন বলে বাঘা বাঘা বোলারদের বিপক্ষে ক্রিজে টিকে থাকাই ছিলো কঠিনসাধ্য বিষয়, সেখানে ওপেনিং জুটিতে ১৪৮ ইনিংসে ৪৭.৩১ গড়ে ঠিক ৬৪৮২ রান! দুর্দান্ত, দুরন্ত….

এবার আপনি একপ্রান্তে গ্রিনিজকে রেখে অপর প্রান্তে কে ছিলো সেটি খুঁজে বের করলে কাকে খুঁজে পাচ্ছেন? উত্তরে আপনি ঠিকই ডেসমন্ড হেইন্সকে খুঁজে নিয়েছেন! হ্যা, সাদা পোশাকে রঙিন ছিলো এই জুটি। ১৪৮ ইনিংসের মাঝে ১১ ইনিংস অপরাজিত থেকে মাঠ ছেড়েছেন গ্রিনিজ-হেইন্স! এছাড়াও সর্বোচ্চ ১৬ বার তিন অংকে পৌঁছেছিলো এই জুটি, যার চারবার পেরিয়েছিলো দুই শতাধিক!
অথচ বাইশ গজে এই জুটি গড়া নিয়েও হয়েছিলো সংশয়! কেননা ব্রিটিশ মুলুকে বেড়ে ওঠা গ্রিনিজে মজেছিলো ইংল্যান্ড। যেকোনো মূলে ইংল্যান্ড গ্রিনিজকে পেতে চেয়েছিলো। কিন্তু গ্রিনিজ স্বপ্ন দেখতেন ক্যারিবিয়ান দেশের হয়ে বিশ্ব মাতাতে। শেষমেশ ১৯৭৪ গ্রিনিজ ফিরেছিলো জন্মভূমিতে। এরপর শুরু হয় তার ক্যারিবিয়ান অধ্যায়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপে পা রাখতে না রাখতেই সুসংবাদ পেয়েছিলো গ্রিনিজ। পূরণ হয়েছিলো ক্যারিবিয়ান জার্সিতে বিশ্ব মাতানোর স্বপ্ন।
১৯৭৪ সাল- ক’দিন আগেই পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ২৭৩ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন নির্বাচকদের। নির্বাচকরাও আর সময় নেননি বেশী। ক’দিনের ব্যবধানে ভারতের বিপক্ষে গ্রিনিজ পেয়ে যায় স্বপ্নের ডাক! সেটিও বাউন্সি উইকেট ছেড়ে ভারতের চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে স্পিন উইকেটে খেলার চ্যালেঞ্জ! এবার গ্রিনিজের সাথে অভিষেক হয় আরেক কিংবদন্তি ভিভ রিচার্ডসের। নিজের অভিষেক টেস্ট রাঙিয়ে দিতে ভুল করেননি ২৩ বছর বয়সী গ্রিনিজ। এশিয়ার স্পিন উইকেটে ভাগবত চন্দ্রশেখর – ভেঙ্কটরাঘবনের বিপক্ষে তুলেছিলেন চার-ছক্কার ঝড়! ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৯৩ রানে রান আউটে কাটা পড়লেও দ্বিতীয় ইনিংসে মেতেছিলেন সেঞ্চুরির উদযাপনে। সেই শুরু…..
চিন্নাস্বামী থেকে অ্যান্টিগুয়া; এরমাঝে ১৮৫ ইনিংস ব্যাট হাতে বাইশ গজে আগমন! নতুন বলের বিপক্ষেও রূঢ়মূর্তি ধারণ করা গ্রিনিজ যেনো পুরোনো বলেই বেশীবার লিখেছেন হতাশার গল্প! সাদা পোশাকে ৫১-৮৯ রানের পাশে গ্রিনিজের ইনিংস সংখ্যা ২৮ সাথে যুক্ত করুন ৬ বার নার্ভাস নাইন্টিসে ভোগার ইনিংস! ১৮৫ ইনিংসের ৩৪ বারই থেমেছেন ৫১-৯৯ রানে! সাথে ১৯ বার তিন অংকের ঘরে নিয়েছেন রান। সবমিলিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে সাদা পোশাকে কাটিয়েছেন রঙিন সব মূহুর্ত। লর্ডসে ডাবল সেঞ্চুরি কিংবা ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে এসে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া! বিশ্বের একমাত্র ব্যাটার হিসেবে ‘রিটায়ার্ড নট আউট’ থাকা। সবটাই করেছেন ওপেনার হিসেবেই।
রিটায়ার্ড নট আউট(অপরাজিত অবসর)! এটা আবার কিভাবে সম্ভব? ক্রিকেটে কেউ ইনজুরিতে পড়লে রিটায়ার্ড আউট বলা হয়। কিন্তু রিটায়ার্ড নট আউট কিভাবে সম্ভব? ফিরতে হবে ১৯৮৩ সালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে। ভারতের বিপক্ষে হেইন্সের সাথে দূর্দান্ত জুটি গড়ার পর হঠাৎই খবর এলো তার দুই বছরের মেয়ে রিয়া গ্রিনিজ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে! কিসের খেলা কিসের কি! গ্রিনিজ ছুটলেন মেয়েকে দেখতে, তখনও অপরাজিত ১৫৪ তে। সেই ইনিংসে আর ব্যাটিং করা হয়নি গ্রিনিজের, দু’দিন বাদের মেয়েকে হারিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে গ্রিনিজের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে আইসিসি থেকে গ্রিনিজের সেই ইনিংসটির পাশে লিখেছিলো ‘রিটায়ার্ড নট আউট’! সেই থেকে আজ অব্দি ক্রিকেটে অপরাজিত অবসরের ঘটনা ঐ একটিই।
টেস্ট ক্রিকেটে চারবার মেতেছে ডাবল সেঞ্চুরির উদযাপনে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটি খেললেও লর্ডসের মাঠে ডাবল সেঞ্চুরিই যেনো গ্রিনিজের সেরা ইনিংস হয়ে আছে। সাদা পোশাকে রঙিন গ্রিনিজ রঙিন পোশাকেও ছিলেন না পিছিয়ে। ১৯৭৫ ও ৭৯ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যও ছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে ১২৭ ইনিংসে ৪৫ গড়ে ৫১৩৪ রান! একজন কিংবদন্তি হতে আর কি দরকার?
১৯৯০ সালে যখন মাত্র ১২১ ইনিংসে পাঁচ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন গ্রিনিজ তখন ওয়ানডেতে তার চেয়ে দ্রুততম পাঁচ হাজার রান ছিলো মাত্র একজনের, তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভিভ। ওয়ানডেতে শততম ম্যাচে সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া প্রথম ব্যাটারও গ্রিনিজ। দুর্দান্তই বটে।
একটা জায়গায় গ্রিনিজের পারফরম্যান্স দেখে চোখ কপালে উঠার মতো অবস্থা! রান তাড়ায় সফল তো অনেক ব্যাটারই। কিন্তু যখন ১১ সেঞ্চুরির ৯ সেঞ্চুরিই করেছেন জয়ী ম্যাচে। এখানেই শেষ নয়, গ্রিনিজ তার খেলা ১০৮ টেস্টে হারের মুখ দেখেছে মাত্র মাত্র ১৪ ম্যাচে। আর এখানে গ্রিনিজ সেঞ্চুরি পেয়েছে এমন ম্যাচে হারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ! অথাৎ ১৯ সেঞ্চুরির সবগুলোই জয়ী/ড্র করা ম্যাচে, কি অনবদ্য গ্রিনিজ।
একটু উপরে ফিরলে লক্ষ্য করবেন, যেখানে বলেছিলাম গ্রিনিজ তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেললেও লর্ডসের ইনিংসি অলিখিত সেরা হয়ে থাকবে। লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৪২ রান! সেটিকেও যে টপকে যাবেন গ্রিনিজের দল সেটি কল্পনা করাও যে দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু ক্রিজে গ্রিনিজ নামক এক ভয়ংকর ব্যাটার থাকলে এমন রানও যে অনায়াসে টপকানো সম্ভব সেটি প্রমাণ হয়েছিলো। সেদিন ৩৪২ রান টপকে জয় পেয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, গ্রিনিজ ২৯ চার ও ২ ছক্কায় অপরাজিত ছিলেন ঠিক ২১৪ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয় পেয়েছিলো ৯ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে। উল্লেখ্য লর্ডসে এখন অব্দি সেটিই সবচেয়ে বড় টার্গেটে জয়। এবার আপনি বলতেই পারেন এই গ্রিনিজকে নিয়ে শুরুতে টানাটানি হয়েছিলো ঠিক এই কারণেই।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের শুরুটা যে রাজকীয় ছিলো সেটি বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। গ্রিনিজ তার দেড় যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ২৩৬ ম্যাচে হারের মুখ দেখেছিলো মাত্র ৫০ বার! ১৪৭ জয়ের মুখ দেখা গ্রিনিজ ড্রয়ের সাক্ষী হয়ে আছেন ৩৭ ম্যাচে, বাকি দুই ম্যাচে রেজাল্ট আসেনি। গ্রিনিজ তার ক্যারিয়ারে ক্যাপ্টেন্সি করেছিলো মাত্র ৯ ম্যাচে, যেখানে একমাত্র টেস্টে হারের মুখ দেখা গ্রিনিজ বাকি ৮ ম্যাচে জয়ের মুখ দেখেছে ৬ বার।
গ্রিনিজ তার ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৬ অধিনায়কের অধীনে। যেখানে তিনি সবচেয়ে সাফল্য পেয়েছে ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে। যেখানে ৫০ গড়ে করেছেন ঠিক ৭০৪০ রান, এছাড়াও ভিভ রিচার্ডসের নেতৃত্বে ১০০ ম্যাচে ৪০ গড়ে করেন ৪৮৭৬ রান। মাত্র ৬ রানের জন্য গ্রিনিজ একটা রেকর্ডের সাক্ষী হতে পারেনি। একমাত্র ব্যাটার হিসেবে চারটি মহাদেশে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড হতো যদি না ভারতের বিপক্ষে ১৯৪ রানে আউট না হতেন। তবে এশিয়ান উইকেটে স্পিন ঘূর্ণির বিপক্ষে এমন ইনিংস ডাবল সেঞ্চুরির চেয়ে কম কিসে!
১৯৯১ সালে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন তখন গ্রিনিজের নামের পাশে ৭৫৫৮ টেস্ট রানের সাথে ৫১৩৪ ওয়ানডে রান জ্বলজ্বল করছিলো। এখানে কতশত রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে আছে সেগুলো তুলে ধরলে বিশাল লেখা লিখতে হবে। সেদিকে যাবোনা, তবে কিছু রেকর্ড তুলে ধরার চেষ্টা করা যাক–
• অভিষেক টেস্ট শতরান।
• টেস্টে এক ম্যাচের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি।
• এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ১ হাজার রানের রেকর্ড (টেস্ট)
• ২১ তম বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও ৬ষ্ঠ বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড।
• টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওপেনিং জুটিতে শীর্ষে রয়েছে গ্রিনিজ-হেইন্স জুটি।
• ১০ ম দ্রুতমত ব্যাটার হিসেবে ওয়ানডেতে ৫ হাজার রান।
• একমাত্র ব্যাটার হিসেবে অপরাজিত অবসর!
এমন অনেক রেকর্ডে জড়িয়ে রয়েছে গ্রিনিজের নাম। গ্রিনিজ তার ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলো ব্রিটিশ মুলুকে। যেখানে ক্রিকেটীয় উত্তাপে মিশে যাওয়া গ্রিনিজ মাত্র ১৯ বছর বয়সে খেলেছিলো কাউন্টি ক্রিকেট। হ্যাম্পশায়ারের জার্সিতে ওপেনিংয়ে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিলেন গ্রিনিজ। যেখানে তার সঙ্গী ব্যারি রিচার্ডস। তাদের ওপেনিং জুটি অল্প কিছুদিনেই নজর কাড়ে বিশ্ব ক্রিকেটে। বিভিন্ন ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তাদের তৎকালীন ওপেনিং জুটি কাউন্টি ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ওপেনিং জুটি হিসেবে পরিচিত। ঘরোয়া ক্রিকেট কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, সবখানেই চড়াও হয়েছে গ্রিনিজের ব্যাট। ক্রিকেটকে বিদায় বললেও ছাড়তে পারেনি ক্রিকেটের মায়া। তাইতো বিদায়ের পরে যুক্ত হয় কোচিংয়ে। এখানেও সাফল্য পান গ্রিনিজ। এবার সেইসব নিয়ে কিছু গল্প জানা যাক।
বাংলাদেশ ক্রিকেট ও একজন গ্রিনিজ!
বাংলাদেশ ক্রিকেটে গ্রিনিজ যেনো পর্দার আড়ালের হিরো হয়ে থাকবেন আজীবন। গ্রিনিজ যখন বাংলাদেশ ক্রিকেটে যুক্ত হলেন তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটা ম্যাচও জয় পাওয়া হয়নি। এমনকি বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতাও অর্জন হয়নি ততোদিনে।
১৯৯৬ সাল, গ্রিনিজ যুক্ত হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে। মূহুর্তেই যেনো গ্রিনিজ মানিয়ে নিলেন সবকিছু, ঠিক যেমন মানিয়ে নিতেন বাইশ গজে নতুন বলের বিপক্ষে নিজেকে। সেবার আকরাম খান, মিনহাজুল, রফিক, খালেদদের নিয়ে বিকেএসপিতে ক্যাম্প করেন আইসিসি ট্রফিতে ভালো করে ৯৯ বিশ্বকাপে জায়গা করার লক্ষ্য নিয়ে। প্রায় পাঁচ মাসের ক্যাম্প শেষে ৯৭ এর আইসিসি ট্রফিতে অংশ নিয়ে মালেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে গ্রিনিজ বাহিনী।

সেই আসরে দারুণ পারফরম্যান্স করে বাংলাদেশ। চাপের মুখে অসাধারণ কিছু ইনিংসের দেখা মিলেছিলো। গ্রিনিজ যেনো চাপকে জয় করার মন্ত্র শিখিয়েছিলেন শীর্ষদের। আর সেটি কাজে লাগিয়ে গ্রিনিজের শীর্ষরা জয় করে ৯৭ এর আইসিসি ট্রফি। এরপর ৯৯ বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়া, পাকিস্তানকে হারিয়ে দেওয়ার টাটকা স্মৃতিতে জড়িয়ে গ্রিনিজের নাম। বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানের গল্পে যার অবদান লিখে শেষ করা সম্ভব নয় সেই তিনিও বরখাস্ত হোন বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে।
বিশ্বমঞ্চে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে গ্রিনিজের বিদায় ঘটেছিলো। সেদিন বাংলাদেশ জয় পেলেও উদযাপনে মাতা হয়নি গ্রিনিজের। অথচ গ্রিনিজের সেদিনের সেই কথাগুলোই সঠিক ছিলো সেটি প্রমাণ করে চলছে বাংলাদেশ। ৯৯ সালে বাংলাদেশ যখন প্রথমবার প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট চালু করে তখন টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলো বিসিবি। ঠিক তখন বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস এতো দ্রুত চাননি তিনি। এতেই বিসিবি তাকে বরখাস্ত করে ফেলেন। শুধু তাই নয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় খেলোয়াড়দের মাঝে গ্রুপিং সৃষ্টি করাসহ আরও কিছু অজ্ঞাত বিষয়ে। সেদিন গ্রিনিজ বিদায় নিলেও তার ভাবনা যে সঠিক ছিলো সেটি বলতেই হয়। এমনকি গ্রিনিজের এমন বিদায় এখনও মানতে পারেন না আকরাম খান, খালেদরা। গ্রিনিজ বাংলাদেশ ক্রিকেটকে যতোটা দিয়েছে তার প্রাপ্য সম্মান কি গ্রিনিজকে দিতে পেরেছে বাংলাদেশ? না।
বাংলাদেশ ক্রিকেট ছাড়লেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের মায়া ছাড়তে যেনো কষ্ট হচ্ছিলো গ্রিনিজের। ২০০০ সালে বিসিবির বিশেষ আমন্ত্রণে আবারও দেশে পা রাখেন গ্রিনিজ। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট নিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে গ্রিনিজ বলেছিলেন, “I am very happy for Bangaldesh and its players, who have done wonderfully well”.
এই গ্রিনিজ যিনি ক্রিকেটার হিসেবে যতোটা সফলতা পেয়েছেন কোচ হিসেবেও তার নামের পাশে যুক্ত কতশত সাফল্য। দিনশেষে গ্রিনিজ নিজেকে নিয়েছেন কিংবদন্তিদের কাতারে। আর এই গ্রিনিজ ১৯৫১ সালের ১লা মে বার্বাডোজের সেন্ট পিটার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে আপনি না থাকলেও ক্রিকেট আপনাকে মনে রাখবে যুগ যুগ। আপনি থাকবেন এদেশের ক্রিকেট ভক্তদের হৃদয়ে, ভালোবাসায়।