শেন ওয়ার্ন বনাম মুরালিধরনঃ সেরা স্পিনারের মুকুট কার দখলে?

Marajul Islam
  • প্রকাশিত সময় : বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০
  • শেয়ার করুন

  • Facebook

লেগ স্পিন যদি একটা শিল্প হয় তাহলে এখানে লিওনার্দো দি ভিঞ্চি কোন তর্ক ছাড়াই শেন ওয়ার্নকে ঘোষণা করা যায়। নিঃসন্দেহে তিনি সর্বকালের সর্বসেরা লেগ স্পিনার। তবে সর্বকালের সেরা স্পিনার কে এই তর্কে গেলে শেন ওয়ার্ন এর সাথে নাম আসে মুত্তিয়া মুরালিধরনের। তবে এখানেই আসল সমস্যাটা। ব্যাপারটা পুরান ঢাকায় কোন বিরিয়ানি কোনটা? হাজি বিরিয়ানি না নান্না বিরিয়ানি! তা বের করার মত। সেরা দশ নির্বাচন করতে বাকি আটটা পজিশন নিয়ে যত তর্ক হবে সেগুলোর সম্মলিত তর্কও এই বিষয়ের সুরাহা দিতে পারবে না। আসলে সর্বকালের সেরা টার্মের বেলায় তর্ক-বিতর্ক খুব স্বাভাবিক বিষয় হলেও এই ক্ষেত্রে তা যেন আরও এক ধাপ এগিয়ে। অনেক রথী-মহারথীদের সাথে আমিও একটু তাল মিলিয়ে নেই।

কে সেরা? ওয়ার্ন না মুরালিধরন। এই প্রশ্নে সবাই টেস্টের স্টাটাস নিয়ে আলোচনা করলেও ওয়ানডের স্টাটাস নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। মুরালিধরন ৩৫০ টি ওয়ানডে খেলে নেন ৫৩৪ টি উইকেট। এভারেজ ২৩.০৮ এবং স্ট্রাইক রেট ৩৫.২। আর ইকোনমি রেট ৩.৯৩। ৪ উইকেট নেন ১৫ বার আর ৫ উইকেট নেন ১০ বার। অন্যদিকে, শেন ওয়ার্ন ১৯৪ টি ওয়ানডেতে ২৯৩ টি উইকেট নেন। এভারেজ ২৫.৭৩ এবং স্ট্রাইক রেট ৩৬.৩। ইকোনমি রেট ৪.২৫। ১২ বার ৪ উইকেট আর ৫ উইকেট নেন ১ বার।

এখানে দুইজনের তুলনা করলে দেখা যায় যে, দুইজন প্রায় সমান। মুরালিধরনের ইকোনমি রেট ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে তিনি ২০১১ পর্যন্ত ওয়ানডে খেলেছেন এই বিবেচনায়। কারণ দিন যত গেছে ব্যাটসম্যানরা ততই আক্রমণাত্বক হয়েছে। বর্তমানে ৫ এর কিছু উপরে ইকোনমি রেট থাকলেও খুব ভাল বলা হয়। আর ৪ এর নিচে সবসময় অসাধারণ বলেই বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেললে প্রতিপক্ষকে পেসাররা শুরু থেকেই চেপে ধরে। তারপর স্পিন আসলে তার উপরে চড়াও হয়ে খেলবে তাই স্বাভাবিক। সেই হিসেবে ৪.২৫ ইকোনমি রেট অস্ট্রেলিয়ান স্পিনার হিসেবে খুব খারাপ নয়। আর এভারেজ আর স্ট্রাইক রেট বিবেচনা করলে তারা দুজনে কাছাকাছি। দুইজনই একটি করে বিশ্বকাপ জিতেছেন। তবে ওয়ার্ন এই দিকটায় এগিয়ে থাকবে। কারণ তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে তিন বার ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জিততে সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছেন। সেই বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল বলতে গেলে তিনিই পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে, মুরালিধরন সবসময়ের মত তার ফর্ম বিশ্বকাপেও ধরে রেখেছেন। তিনি বিশ্বকাপে ৪০ ম্যাচে নেন ৬৮ উইকেট। এভারেজ এবং স্ট্রাইক রেট দুইটাই যথাক্রমে ২০ এবং ৩০ এর আশেপাশে। মুরালিধরনের কোন দেশেই এভারেজ ৩০ এর উপরে যায় নি। পাকিস্তানে ওয়ার্নের এভারেজ ৪৭।

সবমিলিয়ে ওয়ানডেতে দুজনকে সমান বলাই যায়। এবার টেস্টে তাদের ক্যাপের ওজন মাপা হউক। ওয়ার্ন এবং মুরালিধরন দুজনই টেস্ট ইতিহাসে ৭০০ এর বেশী উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ওয়ার্ন ১৪৫ টেস্টে নেন ৭০৮ উইকেট আর ১৩৩ টেস্টে মুরালিধরন নেন ৮০০ উইকেট। ওয়ার্নের ২৫.৪ এভারেজের বিপরীতে মুরালিধরনের ২২.৭। যেখানে ওয়ার্ন প্রতি ৫৭.৪ বলে একটি উইকেট নিয়েছেন সেখানে মুরালি নেন প্রতি ৫৫ বলে এক উইকেট। এই সব বিবেচনায় মুরালিধরন মার্জনালি এগিয়ে রয়েছেন। তবে এটা বিবেচনায় রাখতে হবে মুরালি বেশী টেস্টে খেলেছেন উপমহাদেশের মাটিতে যেখানে উইকেট অনেক বেশী স্পিন নির্ভর। আর ওয়ার্ন তার বেশীরভাগ ম্যাচ খেলেছেন অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে। যেখানে উইকেট স্পিনারদের বেশী সহায়তা করে না।

ওয়ার্ন তার খেলার সময় তার টিমমেটদের অনেক সহায়তা পেয়েছেন। তারা প্রথম দিকে উইকেট তুলে নিয়ে তার ভাল বোলিং এর সুযোগ করে দিত। সুযোগ করে দিত বলার কারণ হল, মনে করি, ২০ ওভারে কোন উইকেট না হারিয়ে ৭৩ রান। আর ২০ ওভারে ২ উইকেটে ৭৩ রান। একজন লেগ স্পিনার ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর বোলিং এ এলে তখন তার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশী থাকে, এই বিবেচনায় ওয়ার্ন তার টিমমেটদের কাছে অনেক সুবিদা পেয়েছে। আবার মুরালিধরনের দলে এক চামিন্দা ভাস ছাড়া আর ককোন হাই কোয়ালিটি বোলার ছিল না। বা বলা যায় ক্যারিয়ারের বেশী সময় শুধু ভাস থেকেই সহায়তা পেয়েছেন। আবার এই বিষয়টা তার জন্য শাপেবর করেছে। মুরালিধরন টেস্টে ৫ উইকেট নেন ৬৭ বার আর ১০ উইকেট ২২ বার। অন্যদিকে, ৩৭ বার ৫ উইকেট আর ১০ বার ১০ উইকেট নেন ওয়ার্ন।

মুরালিধরন তার ঘরের মাঠে ৭৩ টেস্টে ১৯.৬ গড়ে নেন ৪৯৩ উইকেট। প্রতিপক্ষের মাঠে ২৭.৮ গড়ে ৩০৭ উইকেট। আর উপমহাদেশে ৯৭ টেস্ট খেলে ২১.৭ গড়ে নেন ৬১২ উইকেট। অন্যদিকে,ওয়ার্ন বেশী ম্যাচ খেলেছেন দেশের বাইরে। প্রতিপক্ষের মাঠে ৭৬ গড়ে ২৪.৭ গড়ে নেন ৩৭৯ উইকেট। আর ঘরের মাঠে ৬৯ টেস্টে ২৬.৪ গড়ে ৩২৯ উইকেট। উপমহাদেশে ২৫ টেস্টে ২৬.৮ গড়ে ১২৭ উইকেট। ওয়ার্নই একমাত্র বোলার যে উপমহাদেশে ১০০ টেস্ট উইকেট নিয়েছেন। এখানে বলাবাহুল্য, যদি ওয়ার্ন উপমহাদেশে আরও বেশী টেস্ট খেলত তাহলে তার রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ হত। তারা দুজনই আবার ভারতের মাটিতে খেই হারিয়েছে। ওয়ার্ন ভারতে ৪৩.৩ গড়ে ৯ টেস্টে ৩৪ উইকেট নেন। আর মুরালিধরন সেখানে ১১ টেস্টে ৪৫.৪ গড়ে নেন ৪০ উইকেট। ভারতের মাটিতে তাদের এই স্টাটস খুব খারাপ না হলেও সেরাদের সেরার মত নয়। আবার, ওয়ার্নের তার দেশের মাটি অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ায় পারফরম্যান্স ভাল হলেও মুরালিধরন ঐখানে সুবিধা করতে ওারেননি। সেখানে ১৩ উইকেট নিতে তিনি ৭৫ রান করে খরচ করেছেন। বিপরীতে শ্রীলঙ্কায় ওয়ার্ন বেশ সফল। সেখানে তিনি ২০ গড়ে ৪৮ উইকেট নেন। স্ট্রাইক রেটও ৪০ এর নিচে। তবে মাথায় রাখতে হবে মুরালিধরন যেখানে পেস ফ্রেন্ডলি উইকেটে খেলেছেন সেখানে ওয়ার্ন খেলেছেন শ্রীলঙ্কায় নিচু উইকেটে।

ওয়ার্নকে মুরালিধরনের চেয়ে এগিয়ে রাখা হয় নিচের দিকের দলগুলোর বিপক্ষে মুরালিধরনের পরিসংখ্যানের জন্য। মুরালিধরন, বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৫ টেস্টে ১৫ গড়ে নেন ১৭৬ উইকেট। আর ওয়ার্ন এই দুই দলের বিপক্ষে নেন ৩ ম্যাচ খেলে ১৭ উইকেট। তাদের ম্যাচ ছাড়া ওয়ার্নের পরিসংখ্যান দাড়ায় ২৫.৪ গড়ে ৬৯১ উইকেট আর মুরালিধরনের ২৪.৯ গড়ে ৬২৪ উইকেট। তো তাদের বিপক্ষে খেলা তো অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে এদিকে একটা ব্যাপার আছে ২০০১ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে মারভান আতাপাত্তু এবং মাহেলা জয়াবর্ধনে অন্য ব্যাটসম্যানদের খেলার সুযোগ করে দিতে রিটায়ার্ড আউট হয়ে যান। ঐ ম্যাচে মুরালিধরনও খেলেন। তারা তো ইচ্ছে করলে মুরালি কে বিশ্রাম দিতে পারত। যদি তারা বাংলাদেশকে প্রতিপক্ষ হিসেবে ছোট মনে করে থাকে। কিন্তু তারা সেটা করেনি। তবে এই বিষয়ে আরেকটি ব্যাপারও বুঝা যায় মুরালিধরন ছাড়া শ্রীলঙ্কা ছোট দলের বিপক্ষেও খেলতে ভয় পেত!

মুরালিধরন আর শেন ওয়ার্ন পরিসংখ্যান বিবেচনায় কেউ কারও চেয়ে কম যাননা। পরিসংখ্যানে মুরালিধরন কিছুটা এগিয়ে। তবে মাথায় রাখতে হবে ক্রিকেট শুধু পরিসংখ্যানের খেলা না। শেন ওয়ার্নকে লেগ স্পিন নতুন করে আবিষ্কার করার কৃতিত্ব দেওয়া যায়। যদি ওয়ার্ন লেগ স্পিনার না হতেন তাহলে হয়তো মুরালিধরনকেই সবাই একবাক্যে সেরা মেনে নিত। তবে পরিসংখ্যান বাদ দিলে অনেক কারণ পাওয়া যাবে ওয়ার্ণকে এগিয়ে রাখার জন্য। ওয়ার্ন কন্ডিশনের উপরই ভরসা করে থাকত না। তিনি সবসময় বাইরের বেশী কিছু করার চেষ্টা করত। হয়ত উইকেট পড়ছেনা, তখন একটা শর্ট বলে চার খেয়ে পরের বল একই পজিশন থেকে ফ্লিপার দিয়ে বোল্ড করে ফেলত। অন্যদিকে, মুরালিধরনের যে কোন পিচে বলকে স্পিন করার কৃতিত্ব দিতে হয়। বিশেষ করে বলতে হবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতে শ্রীলঙ্কার জয়ে মুরালিধরনের ম্যাচে ১৬ উইকেট নেওয়া। ইংলিশ কন্ডিশনে একজন স্পিনারের ১৬ উইকেট নেওয়ার মোটেও সোজা কথা নয়। হয়ত তার রেকর্ড কোনসময়ই ভাঙ্গবে না।

তবে এই দুজনের মধ্যে সেরার প্রশ্নে একজনকে তো সেরা বলে বিবেচিত করতেই হবে। তাই দুটি বিশেষণে দুজনকে আলাদা করে সেরা কৃতিত্ব দেওয়া যায়। অবশ্যই পরিসংখ্যান বিবেচনায় মুরালিধরন সেরা খেলোয়াড়। তবে খুনে মানসিকতা আর শেষ বিন্দু দিয়ে লড়াই আর মাঠের বাইরের ঘটনা সবমিলিয়ে ওয়ার্নকে ওয়ান বলাই যায়।

 

,

মন্তব্য করুন

এই বিভাগের আরো খবর