সিনিয়র, জুনিয়র আর প্রতিভাবান ধাঁধায় বাংলাদেশ

ডেস্ক নিউজ
  • প্রকাশিত সময় : বুধবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০২১
  • শেয়ার করুন

  • Facebook
Bangladesh Cricket

পঞ্চপান্ডব, ছোট এই শব্দটির সাথে পুরো বাংলাদেশের ক্রিকেটপাগলরাই পরিচিত। তবে শব্দটার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একেক জনের একেক রকম। অনেকের কাছে শব্দটা একটা আবেগ, আবার অনেকেই মনে করেন এই শব্দের আবেগ ঝেড়ে ফেলতে পারেনা বলেই এগোতে পারেনা বাংলাদেশের ক্রিকেট। এক পক্ষ অভিজ্ঞতার মূল্য দিতে গিয়ে কেউ দিনের পর দিন খারাপ করলেও তাকে দলে রাখার পক্ষে, অন্য পক্ষের লক্ষ্য থাকে তারুণ্যের জয়গান গাওয়া। দই পক্ষের মধ্যে থাকে আরেক পক্ষ, যারা স্রোতের সাথে গা ভাসায়, ঠিক বুঝেই উঠতে পারেনা কোন দিকে যাওয়া উচিত আর কোন দিকে যাওয়া উচিত না। তবে সবশেষ বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ওডিআই সিরিজে মাশরাফির না থাকার মধ্য দিয়ে অন্তত পঞ্চপান্ডব শব্দটা জাতীয় দলের সাথে আর থাকছে না নিশ্চিত হলেও আবেগটা থেকেই যাবে।

সামনে এগোতে হবে, দৃষ্টি তাই সামনের দিকে। পেছনের দিকে তাকিয়ে সামনে এগোনো যায় না। তাই তো ২০২৩ বিশ্বকাপের চিন্তা করে আপাতত মাশরাফির সাথে সম্পর্কের ছেদ টেনেই নিলো টিম ম্যানেজমেন্ট; সিদ্ধান্তটাও যৌক্তিকই বটে। সেই যে শতাব্দীর শুরু থেকে কলারটা উঁচু করে ব্যাটস্যানদের চ্যালেঞ্জ জানানো মাশরাফির শেষটা হলো বেঈমান পা দুটোকে সাথে নিয়ে ঘাড়ের রগটা সোজা করে নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই। দলকে তার অনেক কিছুই দেয়া হয়ে গেছে; আপাতত তাঁর জায়গাটা অন্য কারোরই প্রাপ্য সেটা বৃহৎ অংশ মেনে নেবেন নিঃসন্দেহে; হয়তো মেনে নেয়ার সময়ও মনের এক কোণে চিন চিন ব্যাথাটাও সহ্য করবেন, তবে মেনে নেবেনই।

মাশরাফিকে ছাড়াই ঘোষণা হলো স্কোয়াড। পরিবর্তন শুধু ওখানে না, বিশ্বকাপে ওয়ান ডাউনে দুর্দান্ত পারফর্ম করা সাকিবকে চারে নামিয়ে তিন নাম্বার পজিশন দেয়া হলো তরুণ প্রতিভাবান নাজমুল শান্তকে। সাকিবকে চারে নামানোয় স্বাভাবিকভাবেই নিজের থিতু হওয়া পজিশন ছেড়ে দিয়ে পাঁচে নামতে হয়েছে মুশফিককে। মাহমুদুল্লাহ যেখানে খুশি সেখানে খেলে অভ্যস্ত হলেও টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান সৌম্যকে সাতে নামানোর সিদ্ধান্তটাও সেই ২০২৩ বিশ্বকাপ সামনে রেখে পরীক্ষা নিরীক্ষার অংশই; যদিও এই একটা সিদ্ধান্ত অন্যগুলোর থেকে অধীক সমালোচিতও। হাসান মাহমুদের ওডিআই অভিষেক আর মাহেদী হাসান ও শরিফুলের অভিষেকের সম্ভাবনাও এই সিরিজের নতুন কিছুই; ৩ বছরেরও অধিক সময় পর ফেরা তাসকিনও ছিলো আলোচনায়।

এতোসব পরিবর্তন, সিরিজ জয় নিশ্চিত করার পরও সিনিয়দের বিশ্রাম দিয়ে তরুণদের সুযোগ না দেয়া যেমন আলোচনা সমালোচনার বিষয়, তেমনি তরুণ আর তথাকথিত তরুণরাই বা কতটা সফল সেটাও আছে আলোচনার টেবিলেই। সবশেষ ওডিআই সিরিজকে কেন্দ্র করে শুধু ৫০ ওভার ক্রিকেটের কিছু পরিসংখ্যান নিয়ে চেষ্টা করা যাক সিনিয়র, জুনিয়র আর প্রতিভাবান ধাঁধার সমাধান খোঁজার।

আলোচনার শুরুটা ওপেনিং পজিশন থেকেই হোক। এই সিরিজের ৩ ম্যাচেই বাংলাদেশ দলে ওপেন করেছেন পঞ্চপান্ডবের একজন তামিম ইকবাল আর অন্যজন ৫ বছর ধরে ওডিআই খেলেও তরুণ তকমা নিয়ে থাকা প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান লিটন। আলোচনায় আসবে এই সিরিজে সাতে চলে যাওয়া সৌম্য সরকারও। “নেই কাজ তো খই ভাঁজ” কথাটির প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা থেকে টেনে আনবো ইমরুল কায়েসকে; নাইম শেখ আপাতত কিছুটা দূরেই থাকুক।

লিটন এই সিরিজের ৩ ম্যাচে ওপেন করে মোট রান করেছেন ৩৬, যেখানে আছে একটি শূন্য রানের ইনিংসও। এই লিটন কুমারের খেলা ৩৯ টি ম্যাচের সংগ্রহকে তুলে ধরতে চাইলে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। সবশেষ এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের সাথে খেলা ১২১ রানের সেই ইনিংসটি বাদ দিলেও ক্যারিয়ারে আছে আরও ২ টি শতক আর ৩ অর্ধশতক। তাঁর খেলা ১৭৬, ১২৬*, ৯৪, ৮৩ আর ৭৬ রানের ইনিংসগুলোতে প্রতিপক্ষ ছিলো যথাক্রমে জিম্বাবুয়ে, জিম্বাবুয়ে, উইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে আর আয়ারল্যান্ড। এই ৬ টি ইনিংস বাদ দিলে লিটনের বাকি ৩৩ টি ইনিংসের মোট সংগ্রহ সর্বসাকুল্যে ৪৩৯। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন; অবিশ্বাস্য হলেও ৪৩৯ সংখ্যাটাই বাস্তব।

লিটনের পাশাপাশি জাতীয় দলের আরেক তথাকথিত তরুণ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকার। এই সিরিজে তাকে নামানোর কথা ছিলো সাতে, টার্গেট ছোট হওয়ায় নামতে পেরেছেন শুধু শেষ ম্যাচে। অন্যসব পজিশনের কথা বাদ দিয়ে তাঁর ওপেনিং এ খেলা ৩৭ ম্যাচের পরিসংখ্যান নিয়েই কথা বলা যাক। দলের পক্ষে ওপেন করে সৌম্যের খেলা শেষ ১০ ইনিংসের রানগুলো যথাক্রমে ১১, ১৫, ২২, ৩৩, ১৯, ২৯, ২, ২৫, ৪২ আর ৬৬। তাঁর আগের দুটি ইনিংসেও ফিফটি করেছিলেন সৌম্য। ওই পর্যন্তই। ওপেনিং-এ তাঁর গড় ৩৩.৯৭। ওয়ান ডাউনে খেলেছেন ১৩ ম্যাচ, গড় ৩৯.৩৮। ওয়ান ডাউনে সৌম্য শেষবার খেলেছেন ৩১ জুলাই ২০১৯ এ।

লিটন-সৌম্যের সাথে তুলনা করতে আগেই দেয়া কথা অনুযায়ী নিয়ে আসি অনেকটা বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া ইমরুল কায়েসকে। শেষবার ইমরুল জাতীয় দলে ব্যাট হাতে নেমেছেন ২০১৮ এর ডিসেম্বরে। তাঁর শেষ ১০ ইনিংস ০, ৪, ১১৫, ৯০, ১৪৪, ২, ৯, ৭২, ১ আর ৬৮। ১০ ইনিংসেই ২ টি শতক আর ৩ টি অর্ধশতক করা ইমরুলকে জাতীয় দল থেকে দূরে রাখাতে সমর্থন আছে প্রায় সবারই, তবে জিম্বাবুয়ে আর আফগানিস্তানের সাথেই শুধু ভালো করে এই অজুহাতে বাদ দিতে গেলে বাঁধ সাজবে স্বয়ং লিটন আর সৌম্যের পারফমেন্সই।

ওপেনিং এর আলোচনায় বাকি থাকলো একজন, অধিনায়ক তামিম ইকবাল। তামিম ইকবাল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনার আর অন্যতম সেরা ক্রিকেটার সেটা অস্বীকার করার কোনো যায়গা নেই। তবে বিগত কয়েক বছর যাবৎ প্রশ্ন উঠেছে তাঁর এপ্রোচ নিয়ে, তাঁর এংকরিং রোল নিয়ে। এই এপ্রোচের কারণেই নাকি বিপরীত প্রান্তের প্লেয়ারের উপর দ্রুত রান তোলার চাপ এসে যায়। তবে এই ধীর গতির ব্যাটিং-ই যে লিটন সৌম্যের যুগেও তাদের থেকে অনেক এগিয়ে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তামিম ইকবালের শেষ ৫ ইনিংস যথাক্রমে ৬৪, ৫০, ৪৪, ১২৮*, ১৫৮। তাঁর আগের ৫ ইনিংসে যদিও ব্যার্থ ছিলেন তবে বাকিদের থেকে এগিয়েই। ২০১৫ থেকে ২০২১ পর্যন্ত তিনি ম্যাচ খেলেছেন ৭৫ টি যেখানে নট আউট ইনিংস আছে পুরো ক্যারিয়ারের ৯ টির ৮ টিই। এ সময়ে তাঁর গড় ৫১.৩৪ হলেও স্ট্রাইক রেটটা ৮০ এর নিচে যা প্রশ্ন তোলার জন্য যথেষ্ট। তবে এই প্রশ্নটা আটকে দেয়া যায় বাকিদের পারফরমেন্স দিয়ে। তাই আপাতত তামিম তাঁর স্ট্রাইক রেট আরেকটু বাড়ানোর চেষ্টা করবেন সেটাই চাওয়া, তবে না বাড়ালেও চুপ করেই থাকতে হবে যতদিন না সেই শুরুর তামিমের মতো নতুন কাউকে পাচ্ছি কিংবা ফিরে পাচ্ছি শুরুর সৌম্যের মতো সৌম্যকে। নাইম শেখ কতটা কি করতে পারেন সুযোগ পেলেই দেখা যাবে, সেই আশা নিয়েই পদার্পন করা যাক পরের আলোচনায়।

সিনিয়র-জুনিয়র ধাঁধাটা ৩ নম্বর পজিশনে এসে লাগবে ভালোভাবেই; অন্তত এই সিরিজের পরতো অবশ্যই। ওয়ান ডাউনে একজন পারফেক্ট ব্যাটসম্যানকে খুঁজে পেতে ভালোই ভুগতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে। ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিবকে তাঁর প্রিয় ৩ নাম্বার পজিশন দিয়ে ভালো ফলও পেয়েছিলো দল। নিজেকে বিশ্বদরবারে নতুন করে পরিচিত করান সাকিব সেখান থেকেই। তবে হঠাৎ করেই সাকিবের জায়গাটা শান্তকে দিয়ে সাকিবের তো বটেই, মুশফিকের পজিশনও বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলো টিম ম্যানেজমেন্ট। সাকিব আর মুশফিক যেকোনো যায়গাতেই নিজেদের প্রমাণ করতে পারবেন, নিজেদের সেরাটা দিতে পারবেন। তাদের পজিশন নিয়ে কথা বাড়ানো অনর্থক। তবে দুটো প্রশ্ন তারপরো আসতেই পারে। প্রশ্ন দুটি:
১) সাকিবকে তিন বাদে চারে দেয়ার প্রয়োজন কতটা?
২) তিন নাম্বার পজিশন থেকে নামাবেই যখন তখন মুশির জায়গা ঠিক রেখে সাকিবের আগের জায়গা ৫ নম্বর পজিশনে কেনো সাকিবকে পাঠানো হলো না?

প্রথম প্রশ্নের উত্তরটা দিতে গেলে অনেক কিছুই দেয়া যাবে, টিম ম্যানেজমেন্টের বুঝটা কি ছিলো সেটা তারাই ভালো জানেন। তবে যেহেতু অনূর্ধ্ব ১৯ লেভেলের পর ডোমেস্টিকেও শান্ত ধারাবাহিক ভাবেই ভালো পারফর্ম করছে, সেহেতু তাকে দলে জায়গা দেয়াটা প্রয়োজন ছিলো। আর একজন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে টপ অর্ডারেই যায়গা দেয়া উচিত। সাথে যেহেতু তিন নাম্বার পজিশনে পারফেক্ট প্লেয়ার পেতে বাংলাদেশকে অনেকগুলো দিন কাটাতে হয়েছে, সেহেতু শান্ত যদি এখনই তিন নম্বর পজিশনে নিজেকে থিতু করতে পারেন তবে ভবিষ্যতে দলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ন একটা ব্যাটিং পজিশন নিয়ে আর চিন্তায় পরতে হবে না খুব একটা। এসব চিন্তা করেই হয়তো শান্তকে তিনে আনা আর সাকিবকে চারে।

চার নাম্বার পজিশনে সাকিব আল হাসান

সাকিবকে চারে না দিয়ে মুশিকে তাঁর জায়গায় রেখে সাকিবকে তাঁর আগের পরীক্ষিত যায়গাতেই কেনো দিলো না? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, দুজনই দলের গুরুত্বপূর্ন সদস্য, দুজনই যেকোনো যায়গায় নিজেদের সেরাটা দিতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে সাকিবের থেকে দল যত বেশি পাবে ততটাই দলের লাভ। এই চিন্তাতেই হয়তো তাকে পাঁচে না পাঠিয়ে চার নম্বর পজিশন দেয়া হয়েছে, তবে মুশফিকও যে দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সেটাও অস্বীকার করার জায়গা নেই। তাই এই লজিককে কেউ ভুল বললে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। এটাকে সমাধান না করা অবস্থাতেই চলে যেতে চাই পরের প্রশ্নসমূহে।

১) তিন নাম্বার পজিশনে শান্ত কতটা সফল?
২) শান্ত যদি সফল না হয়ে থাকে তবে এই জায়গাটা সৌম্যকে কেনো দেবে না?

নাজমুল শান্ত প্রতিভাবান, জাতীয় দলে এখন অব্দি সেররকম ভাবে সুযোগ পাননি। তাই কয়েক ম্যাচ দিয়েই তাকে বিচার করাটা হবে বোকামি। লিটন-সৌম্যদেরও কয়েক ম্যাচ দিয়ে বিচার করা বোকামি ভেবেই এ অব্দি এসেছে বাংলাদেশ দল। যাক সে কথা, নাজমুল শান্ত মোট ওডিআই খেলেছেন ৮ টি; ৮ টি ম্যাচই টপ অর্ডারে। ৩ টি ওপেনিং এ আর ৫ টি ওয়ান ডাউন পজিশনে। ৮ ম্যাচে তাঁর মোট সংগ্রহ ৯৩, সর্বোচ্চ ২৯, এক অঙ্কের ইনিংস খেলেছেন ৫ বার, স্ট্রাইক রেটটাও মাত্র ৫৯.৮৬। সুযোগ তিনি অবশ্যই ডিসার্ভ করেন; কিন্তু সুযোগটা যেন বুঝ শুনে সহনশীল মাত্রার থাকে। তাঁর উপর সাকিবের জায়গা তাকে দেয়ায় একটা আলাদা চাপও যে সে বহন করছে সেটাও ঠিক।

শান্ত ৩ ম্যাচে টানা ব্যর্থ এই জন্যই সেখানে আবার সৌম্যকে নিয়ে আসা কতটা যুক্তিযুক্ত তা জানিনা, তবে সৌম্যকে খেলানো হলে ওই ওপেনিং কিংবা ওয়ান ডাউনেই রাখুক, নয়তো ব্যাক আপ হিসেবে স্কোয়াডে থাকুক, সাত নাম্বারে খেলানোর কোনো মানে হয় না। সাতের জন্য মাহেদী, সাইফউদ্দিনদের তৈরি করাটাই অধিক কার্যকর হবে বলে মনে করি। যদিও সৌম্যই বা কতটা সফল তা নিয়ে খানিকটা আলোচনা আগেই করা হয়েছে।

মুশফিক বা মাহমুদুল্লাহকে নিয়ে আপাতত কোনো কথা নেই। মুশির কিপিং নিয়ে যৌক্তিক কারণেই বারবার প্রশ্ন উঠে, রিয়াদের টেস্ট পারফরমেন্স নিয়ে প্রশ্ন উঠে; তবে ওডিআই তে এখনো তারা বাংলাদেশ দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ২০২৩ বিশ্বকাপের চিন্তা করে কাউকে বাদ দিতে গেলে আগে তো কোনো নতুন প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে তুলে আনতে হবে অথবা ৫ বছর ধরে খেলেও তরুণ ট্যাগ সমহিমায় ধরে রাখাদেরকে ছন্দে আসতে হবে। তাই অন্তত তাদের নিয়ে কোনো কথা বলার অবকাশ নেই। কথা আসতে পারে মিথুন, আফিফ, মেহেদি মিরাজ, মাহেদী, মোসাদ্দেকরা দলের জন্য কতটা কি করতে পেরেছেন বা ভবিষ্যতে করতে পারবেন? ইরফান শুক্কুর, ইয়াসির রাব্বিরা এখনো নতুন, আলোচনার বাইরেই থাকুক।

আফিফ হোসেন ওডিআই খেলেছে শুধু একটি, মাহেদী, ইয়াসির রাব্বি, ইরফানরা আসতে চাচ্ছে। মাহেদীকে আসতে হলে প্রতিযোগিতা করতে হবে মেহেদি মিরাজের সাথে। বাকিদের জন্যও দলে জায়গা সেভাবে নেই। মোসাদ্দেককেও এখানেই বিবেচনা করা যায়। মিথুনকে এখানে বিবেচনা করলে তাঁর থেকে বাকি ৩ জন এগিয়ে থাকবে অলরাউন্ডার হওয়ায়।

মিথুন, মোসাদ্দেক আর মেহেদি মিরাজ তাদের জায়গায় কতটা সফল? উত্তরটা আলোচনা সাপেক্ষ। সৈকত বাংলাদেশ দলে একদিনের ক্রিকেটে খেলেছেন ৩০ ইনিংস। এর মধ্যে নিচে ব্যাট করায় সবসময় ব্যাটিং এর পুরো সুযোগটাও পাননি, সেক্ষত্রে নট আউট ইনিংসের সংখ্যা বেশি থাকার কথা ছিলো। বেশি থাকার কথা ছিলো গড়টাও। যদিও তাঁর ৩০ ইনিংসের মধ্যে ১০ টিতে নট আউট থাকার পরো গড়টা মাত্র ২৭.৪৫। তাঁর ব্যাট হাতে নামা শেষ ১০ ইনিংসে নট আউট ইনিংস একটি। শেষ ১০ ইনিংস যথাক্রমে ১৩, ১২, ১৬, ৩, ৩৫, ২৬, ১১, ২৬, ৫২* এবং ১৪। বোলিং এও ততটা মেলে ধরতে পারেননি নিজেকে, পার্ট টাইম বোলার হিসেবে সর্বোমোট ১৫০.২ ওভার বল করে উইকেট নিয়েছেন ১৪ টি।

মিরাজ আবার এদিক দিয়ে এগিয়ে, গড় যদিও ৩৬.১০ আর স্ট্রাইক রেট যদিও ৪৭.৯; তবুও ৪৪ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ৪৭ টি। তবে ব্যাটিং তো তাঁর করাই হয়ে উঠে না জাতীয় দলে। ৪৪ ম্যাচের মধ্যে ব্যাট হাতে নেমেছেন মাত্র ২৬ টিতে, সেখানেও ব্যর্থ তিনি। অপরাজিত থাকতে পেরেছেন মাত্র ৪ বার। ব্যাটিং গড়টা মাত্র ১৭.৮৬ আর স্ট্রাইক রেট ৭৭.৩৬। মিথুনও একই রকম। ২৩ ইনিংসে ব্যাট করে গড় ২৮.৭৫। শেষ ১০ ইনিংসে নট আউট একবার, অর্ধশতক একটি, বাকি সব তাইরে নাইরে না। ম্যানেজমেন্ট যদি এখানে সাহস করে মাহেদীকে সুযোগ দিতে চায় তো নির্দ্বিধায় দিতে পারে, দেখা যাক না কি হয়! অন্তত যারা আছে তাদের থেকে তো খারাপ করবেন না আশা করা যায়।

পেস বোলিং অলরাউন্ডারের যায়গায় সাইফউদ্দিনের বিকল্প এই মুহূর্তে নেই। ২৩ ম্যাচে ৫.৮৬ ইকোনোমিতে ৩৪ উইকেটের সাথে ১৪ ইনিংসে ৮৭ স্ট্রাইক রেট আর ৩২.৭৭ গড়ে ব্যাট করার মতো প্লেয়ার পাইপলাইনে খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে না। তরুণ মাশরাফির মতো একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার হয়তো হতে পারবেন সাইফউদ্দিন, তবে মাশরাফির মতোই ইনজুরির সাথে যুদ্ধ করতে পারলে।

মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন

জেনুইন বোলারদের দিকে নজর দেয়া যাক। স্পিনারদের দিকে নজর দিলে শুধু স্পিন করতে পারে এমন বোলারের প্রয়োজন এখন তেমন নেই, অলরাউন্ডারদের দিয়েই কাজটা সেরে ফেলা যায়। সাকিব, মিরাজ আছেন, প্রয়োজনে মাহেদী, আফিফরা সঙ্গ দেবেন। জেনুইন স্পিনার তাইজুল বা অপুর আপাতত ওডিআই ক্রিকেটে প্রয়োজন নেই। তবে লেগ স্পিনারের প্রয়োজন আছেই। পারফেক্ট একজনকে খুঁজে না পাওয়া অব্দি এভাবেই চলুক।

পেসারদের কথা বললে অনেকগুলো নাম আসবে। রুবেল, মুস্তাফিজ, তাসকিন, হাসান মাহমুদ, আল আমিন হোসাইনদের নাম আসবে শুরুতে। শরিফুল ইসলাম, মৃত্যুঞ্জয়রাও পাইপলাইনে আছে। মুস্তাফিজকে নিয়ে কথা নেই। রুবেলকে নিয়ে শুরু করা যাক।

২০০৯ এ অভিষিক্ত রুবেল হোসেন ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ওডিআই খেলেছেন ৫০ টি। ২০২০ এ কোনো ওডিআই খেলেননি। এই ৫০ ম্যাচে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৫৭ টি। এই ৫ বছরের মধ্যে তাঁর সবথেকে ভালো পারফরমেন্স ছিলো ২০১৮ তে; ১৪ ইনিংসে ২৩ উইকেট, এভারেজ ২২.০৮। এরপরই ২০১৫, ১৪ ম্যাচে ১৮ উইকেট। গড় ৩৪.০৫। ২০১৬ সালে রুবেল হোসেন ম্যাচ খেলেছেন ২ টি। বল করেছেন ৭২ টি, রান দিয়েছেন ৮৬ আর উইকেট সংখ্যা ১। তাঁর এই পরিসংখ্যান আফগানিস্তানের বিপক্ষে ঢাকায়। ২০১৭ সালে ১০ ইনিংসে বল করেছেন ৮৪ ওভার। উইকেট সংখ্যাও ১০ টি। একটি উইকেট পেতে বল করতে হয়েছে ৫০ টিরও বেশি, একটি উইকেটের জন্য খরচও করেছেন ৫০ রানের বেশি। ২০১৯ এ ৬ ম্যাচে উইকেট সংখ্যা ৫ টি। উইকেট প্রতি বল করেছেন প্রায় ৬১ টি আর রান দিয়েছেন ৬৯। ২০১৮ তে রুবেল ম্যাচ খেলেছে জিম্বাবুয়ে, শ্রীলংকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আর এশিয়া কাপে। ১৪ ম্যাচের ৭ টি দেশের মাটিতে, ৭ টি বিদেশে। ২০১৫ সালে বিশ্বকাপের পাশাপাশি ৮ ম্যাচ খেলেছেন দেশেই। পারফরমেন্স ২ জায়গাতেই সমান।

মাশরাফি এখন দলে নেই, রুবেলেরই হওয়া উচিত ছিলো স্ট্রাইক বোলার, পেস ডিপার্টমেন্টকে লিড দেয়া কথা তাঁর। সেখানে তারই যদি এমন হ য ব র ল পারফরমেন্স হয় তখন তো আর তাকে দলে রাখা যায় না। রুবেলের শেষের শুরুটা হয়তো হয়ে গেছে। ২০১৯ এর জুলাই থেকে রুবেল দলের বাইরেই ছিলো, বঙ্গবন্ধু টি২০ এর মলিন পারফর্মেন্সের পরেও দলে আবার পাওয়া সুযোগটা কাজে লাগাতে না পারাটা হয়তো রুবেলের শেষ। ২০১৭ এর অক্টোবরের পর আবার ফিরে আসা তাসকিনের সামনে সুযোগ আছে প্রাপ্ত সুযোগটা কাজে লাগানোর। হাসান মাহমুদ নিজেকে যথেষ্ট প্রমাণ করেছে, তবে ২ মাচ দিয়ে বিচার করা যায় না। বাকিরাও সুযোগ পেলে নিজেদের প্রমাণ করতে পারবে আশা করি। তবে মুস্তাফিজ, তাসকিনদের সাথে বা তাঁর পরে শুরু করা কাসিগো রাবাদা, জাসপ্রিত বুমরাহরা নিজেদের অনেক উঁচুতে নিয়ে গেলেও আমাদের বোলাররা থেকে যায় আগের মতোই। সৌম্য, সাব্বিরদের সাথে বা পরে শুরু করা পান্ডিয়ারা দলে নিয়মিত পারফর্ম করে গেলেও আমাদের সাব্বির জাতীয় দল থেকে চলে গেছে বহুদূরে। এটাই মূল সমস্যা।

শেষ করার আগে ২ টি টপিক নিয়ে আরেকটু কথা বলব। প্রথম টপিকটা “পঞ্চপান্ডবের বাকি ৪ জনের সমস্যাটা কি?” আর দ্বিতীয়টা, “এই সমস্যাগুলো থাকলেও আমাদের কিছুই করার নেই কেনো?”

চার সিনিয়রের সমস্যা নিয়ে কথা শুরু করলে শুরুতেই আসবে তামিম ইকবালের ডট খেলা। কথা সত্য, তামিম ইকবাল বাকি ৩ জনের থেকে অনেক বেশি ডট খেলেন। বাকি ৩ জনের থেকে বেশি সংখ্যক বাউন্ডারি হাকিয়েও স্ট্রাইক রেট বাকিদের কাছাকাছি থাকাটা অবশ্যই দোষের। মুশফিক, সাকিবের ডট বলের সংখ্যা ৫০ শতাংশ আর ৪৮ শতাংশ। যেখানে তামিমের ক্যারিয়ারে ডট বল মোট বলের ৫৭ শতাংশই। সুতরাং ডট খেলার দোষটা তামিমের অনেক বেশিই। এতো বেশি ডট তামিম দিলেও ব্যাটিং এভারেজ কিন্তু বাকি ৩ সিনিয়রের কাছাকাছিই। রিয়াদ ৩৪.২৩, মুশি ৩৬.৬৪, তামিম ৩৬.৯৮ আর সাকিব ৩৮.০৮। স্ট্রাইক রেটের হিসেবেও সাকিব কিছুটা এগিয়ে, বাকি ৩ জন ৭৭, ৭৮ আর ৭৯। অর্থাৎ স্ট্রাইক রোটেট না করাটা যেমন তামিমের দোষ, তেমনি অল্প স্ট্রাইক রেটে খেলাটা সাকিব, মুশফিক আর রিয়াদেরও দোষ। মুশফিকের কিপিং নিয়ে আলাদাভাবে প্রশ্ন আসে। কিপিং এর সমস্যা সমাধান না হওয়ার কারণ মুশফিকের একঘেমেয়িতাই। তবে তাদের ডট খেলা বা স্লো খেলার সমাধান হয় না অন্য কেউ তাদের কাছাকাছি আসতে পারে না বলে।

লিটন সৌম্যদের স্ট্রাইক রেট অনেক ভালো, তবে শুধু স্ট্রাইক রেট দিয়ে তো আর ম্যাচ জেতা যায় না। সিনিয়র চারজন পারফর্ম না করলে বাকিরা যে দায়িত্ব নিতে পারছে না তা প্রমাণিত। বাকিরা কেনো জাতীয় দলে এসে আউট অফ ওয়াটার বিহেভ করে সেটা খুঁজে বের করে রুট লেভেল থেকে মেরামত না করতে পারলে সমস্যা থেকেই যাবে। লিটন-সৌম্যরা দারুণ প্রতিভা নিয়ে এসে কিভাবে জাতীয় দলে ফ্লপের পর ফ্লপ যায়, অনূর্ধ্ব ১৯ লেভেলের অশান্ত পারফর্মার শান্ত কেনো জাতীয় দলে এসে সুবিধা করতে পারে না, নাসির-সাব্বিররা কেনো জাতীয় দল থেকে হারিয়ে যায় তা খুঁজে বের করে সমাধান না করতে পারলে সামনে যে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে তা একপ্রকার নিশ্চিত।

শেষ করব! তবে পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই যে, সিনিয়রদের ছাড়া বাংলাদেশ দল এখনো অচল। ৪/৫ বছর ধরে ক্রিকেট খেলা তরুণেরা যতদিন সিনিয়র না হচ্ছেন বা প্রতিভাধর ক্যাটাগরি থেকে বের হয়ে প্রুভেন পারফর্মারদের দলে নাম না লেখাচ্ছেন; ততদিন এই সিনিয়র, জুনিয়র আর প্রতিভাবান ধাঁধা সমাধান হওয়ার নয়।

 

,

মন্তব্য করুন

এই বিভাগের আরো খবর