১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সৈয়দ রাসেল : বাংলার কিং অফ সুইং!

প্রতিবেদক
Md Riyad Hasan Riyaz
শুক্রবার, ৩ জুলাই , ২০২০ ১০:৪৩

অতি সাদামাটা চেহারার মানুষগুলোকে দেখে তাকে চেনাটা হয়ে যায় মুশকিল। সাধারণ চেহারার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে এমন এক দুর্জয় শক্তি যা কল্পনার বাইরে। মোমেন্টস, অবিশ্বাস, মায়া, দেয়াল, অক্ষর, দূরবীন, বীর, রূপও আলোর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এরা মানুষের মনে জায়গা করে নেন। অনেক সময় পর্দার আড়ালে থেকেও তারা হয়ে উঠে ‘আনসাং হিরো।’ ক্রিকেটে ‘আনসাং হিরো’ নেহাত কম নয়। দলের প্রয়োজনে তারা অনেক সময় আড়ালে ঘায়েল করে প্রতিপক্ষকে। আড়ালে ঘায়েল করে বলেই হয়তো তাদের নামটা উচ্চারিত হয়না গ্রেটদের সাথে। তবে তাদের নাম কিন্তু ঠিকই রয়ে যায় ইতিহাসের পাতায় আর মানুষের মনের খাতায়।

প্রত্যেকটি খেলায় অনেক খেলোয়াড় আসে কেউ টিকে থাকতে পারে কেউ বা হারিয়ে যায় সময়ের ব্যবধানে। সৈয়দ রাসেল তেমনই একজন যিনি হারিয়ে গেছেন ক্রিকেট অঙ্গন থেকে অনেক আগেই! তবে রাসেল হারিয়ে যাননি এদেশের হাজারো ভক্তের মন থেকে। উইকেট যেমনই হোক ম্যাচের শুরু থেকে বাঁহাতি মিডিয়াম পেস আর দারুণ সুইংয়ে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে খাবি খাওয়ানো, কৃপণ বোলিং কিংবা দ্রুত ব্রেক থ্রু এনে দেওয়ার দক্ষতা সম্পূর্ণ বাংলাদেশী এক পেসারের নাম সৈয়দ রাসেল।

নিখুঁত লাইন ও লেন্থে ক্রমাগত বল করে যাওয়া, বলে তেমন গতি না থাকলেও তার আটসাট বোলিং, উইকেটের দু’দিক থেকে সুইং করানো এবং অতি কৃপন বোলিংয়ে প্রতিপক্ষের রান আটকানোতে খুব দক্ষ ছিলেন এই মিডিয়াম পেসার।

সৈয়দ রাসেলকে বলা হতো ‘বাংলার চামিন্দা ভাস’। এই চামিন্দা ভাসের উপাধি আমি আপনি দেইনি দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ও অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার। ২০০৫ সালে প্রশিক্ষণ সফরের জন্য দেশের একদল তরুণ ক্রিকেটারকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ঐ প্রশিক্ষণ সফরের তখনকার ২১ বছর বয়সী রাসেলকে মোকাবেলা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট জাস্টিন ল্যাঙ্গার। একদিন সৈয়দ রাসেল জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে ৪ বার আউট করেন। তখনও ল্যাঙ্গার খেলার মধ্যেই ছিলেন এবং সময়ের সেরা সেরা বোলাররা সেসময় তাকে আউট করতে খাবি খেতেন। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ না পাওয়া রাসেল তার সুইংয়ের জাদুতে অনায়াসে জাস্টিনকে ৪ বার আউট করে বসলেন! আর তাতেই জাস্টিন রাসেলে মুগ্ধ হয়ে তাকে দিলেন বাংলার চামিন্দা ভাসের তকমা।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখন ছিল বাঁহাতি পেস বোলারের চরম অকাল। বাঁহাতি পেসার বলেই নয় বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবসময়ই পেসারদের থাকে অকাল। ঘরোয়া ক্রিকেট হোক বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বাংলাদেশে স্পিনারাই সবসময় প্রাধান্য পায়। একাদশে তিন পেসার খেলানোর সিদ্ধান্ত নিতে এখনকার সময় এতটা না ভাবলেও, রাসেলের সেইসময়ে সেটা ছিল এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত! স্পিনারদের কথা মাথায় রেখে তখন সবসময় স্পিনবান্ধব উইকেট তৈরি করা হতো বাংলাদেশে। পেসারদের জন্য উইকেটে কিছুই থাকত না। আর সে মরা উইকেটে সুইং করাতে তাঁর মত দক্ষ বোলার তখনকার সময় বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি স্মরণীয় জয়ের অনেকগুলোতেই ছিল রাসেলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

২২ ফ্রেরুয়ারি ২০০৬ সাল প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা:
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বগুড়ায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে অভিষেক হয় রাসেলের। রাসেলের অভিষেক ম্যাচে প্রথমবারের মত শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ছিল বাংলাদেশ। অভিষেক ম্যাচে সৈয়দ রাসেল ছিলেন উজ্জ্বল। বল হাতে ১০ ওভার বল করে ২ মেডেন দিয়ে ২.৩৮ ইকোনমিকতে ২৮ রান খরচায় নিয়েছিলেন ২ উইকেট। সেদিন মাত্র ২১২ রানে অলআউট হয়েছিল লঙ্কানরা। তারপর ব্যাটসম্যানদের কল্যানে ৪ উইকেটের জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২১ বলে ৩২ রানের ম্যাচ উইনিং নক সাথে বোলিংলয়ে ১ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেয়েছিল আফতাব আহমেদ। অবশ্য ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেত সৈয়দ রাসেল যদি না তার বলে দুইটা ক্যাচ মিস না হতো। তাহলে অভিষেকে ৪ উইকেটের সাথে কৃপণ বোলিং করে ম্যাচ সেরা পুরস্কার তার হাতেই উঠত।

১৭ মার্চ ২০০৭ সাল প্রতিপক্ষ ভারত:
২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৬ উইকেটের জয়। পোর্ট অব স্পেনে মাশরাফির পেসে নাকাল ভারতীয় ব্যাটসম্যান। ৯.৩ ওভার বোলিং করে ২ মেডেন দিয়ে ৩৮ রান খরচায় মাশরাফি উইকেট নিয়েছিল ৪ টি। ঐ ম্যাচে তিন বাঁহাতি স্পিনার রাজ্জাক, রফিক ও সাকিব আল হাসান সবাই করছিলেন কিপটে বোলিং। কিন্তু চার বোলার দের ছাড়িয়ে সবচেয়ে কৃপন ছিলেন সৈয়দ রাসেল। ঐ ম্যাচে ১০ ওভারে রাসেল দিয়েছিলেন মাত্র ৩১ রান ইকোনমিক ছিল সবার থেকে কম ৩.১০। কিন্তু উইকেট শূন্য থাকায় রাসেলের ঐ বোলিং পারফরম্যান্স হয়তো কারো নজর কাড়েনি।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সাল প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ:
৪-১-১০-১; এই অবিশ্বাস্য বোলিং ফিগারে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ের পেছনে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল সৈয়দ রাসেল। টান টান উত্তেজনাপূর্ণ সেই ম্যাচে নিজের নিয়ন্ত্রিত সুইংয়ের জাদুতে ২২ গজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলেছিল বাংলাদেশী দুর্দান্ত এই বাঁহাতি মিডিয়াম পেস বোলার। প্রথম ওভারেই আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করা ক্রিস গেইলকে শূণ্য রানে প্যাভিলিয়নে পথ দেখান রাসেল। ঐ ম্যাচে আফতাব ও আশরাফুলের ঝড়ো ব্যাটিং বাংলাদেশ পেয়েছিল ৬ উইকেটের জয়। আর সে ম্যাচেও আড়ালে ছিল রাসেলের পারফরম্যান্স।

এসব আড়াল করা পারফরম্যান্স দিয়ে দীর্ঘ ৬ বছর
জাতীয় দলের পেস বিভাগে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে আলো ছাড়াতেন লাল সবুজের জার্সি গায়ে। তার বলে পেস নেই তারপরেও সুইংয়ে বিষে নীল হয়েছিল সময়ের সেরা সেরা ব্যাটসম্যান। যদিও জাতীয় দলে থাকা অবস্থায় নিজের প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন পাননি তিনি। কোচের অনাগ্রহ ও কাঁধের ইনজুরিতে পড়ার পর বিসিবির অবহেলায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি সৈয়দ রাসেলের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬ টি টেস্ট, ৫৩ টি ওয়ানডে ও ৮ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে ক্রিকেট ২০১৫ সালে ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেন। ৬ টেস্টে ১২, ৫২ ওয়ানডেতে ৬১ এবং ৪ উইকেট সংগ্রহ করেছেন সৈয়দ রাসেল।

ক্রিকেটে এসেছিলেন বহুদূর যাবার স্বপ্ন দেখিয়ে। কিন্তু ক্যারিয়ার জুড়েই ইনজুরির বাগড়ায় আর অবহেলায় স্বপ্নটা দীর্ঘ হয়নি তার। তবে রাসেল হয়েছেন বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা বাঁ-হাতি পেসারের একজন।

,

মতামত জানান :