৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ক্রীড়া সাংবাদিকতায় নৈতিকতা কি মিথ? না বাস্তব?

প্রতিবেদক
ডেস্ক নিউজ
শুক্রবার, ২৪ জুলাই , ২০২০ ১১:২৫

” সুস্থ হয়ে গেছেন মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা”, ” দল থেকে বাদ পড়ছেন তামিম ইকবাল”, ” দেশের হয়ে আর টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চান না সাকিব আল হাসান”, এ ধরনের মিথ্যে বা মিসলিডিং শিরোনাম প্রায়ই আমাদের চোখের সামনে আসে। এ ধরনের খবরগুলোকে আমরা কেউ প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করে ফেলি, কেউ বা এই শিরোনামগুলোর ভিত্তিতে সাধারণীকরণ করে জাজমেন্টে উপনীত হই। ফলস্বরূপ অনলাইন, অফলাইনে ঝড় ওঠে। তর্ক, বিতর্ক, বাহাস চলে রাতদিন। শেষমেশ ক্রিকেটারদের ফেসবুকে লাইভে এসে নিজেদের অবস্থার আপডেট দিতে হয় কিংবা অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হয়। কিন্তু দিনশেষে লাভের গুড় কে খায়? চটকদার শিরোনামের পৃষ্ঠপোষকরাই তো। তারা বলেন, এটা তাদের পেশা। নৈতিকতা কিংবা বস্তুনিষ্ঠতা কি তাহলে কেবলই একটা মিথ? কেবল গালভরা বুলি আর পাঠ্যপুস্তকের ভাষাতেই সীমাবদ্ধ?

আজ থেকে ৩২ বছর আগে বিখ্যাত আমেরিকান চিন্তক নোয়াম চমস্কি ও আরও তিন ব্যক্তি মিলে “Manufacturing Consent: The Political Economy of the mass media” নামে একটি বই লেখেন। এই যুগান্তকারী বইয়ে তিনি একটি “প্রোপাগান্ডা মডেল” উপস্থাপন করেন, যে মডেলে তিনি “প্রোপাগান্ডা” সৃষ্টিতে বা ছড়াতে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, নিয়মিত কার্যকলাপের পাশাপাশি গণমাধ্যমের আরেকটা কাজ হচ্ছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতাদানকারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার্থে কিংবা স্বার্থের প্রচারণা চালাতে প্রোপাগান্ডা সৃষ্টি করা। আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশের প্রথম সারির পত্রিকাগুলো বড় বড় কর্পোরেট হাউজের পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে চলে। দেখা যায় যে, একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাতেই অনেকগুলো পত্রিকা। প্রথম সারির সবগুলো পত্রিকা বা চ্যানেলই দু’তিনটে প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়। বড় বড় নামেরা এসব পত্রিকাতে কাজ করে থাকেন। তাদের কেউ কেউ এক যুগ, দু’যুগ ধরে চাকরি করছেন। কিন্তু স্বীয় প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার্থে তারা কখনো কখনো ভব্যতার সকল সীমাও অতিক্রম করে ফেলেন। তখন “মোরালিটি” হয়ে যায় কাগুজে টার্ম। খবরের কাটতি বাড়ানোই হয়ে যায় মুখ্য। কখনো তাদের দেখা যায় কোনো নির্দিষ্ট ক্রিকেটারের পেছনে আদাজল খেয়ে লাগতে। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য ক্রিকেটারের সাথে একটি বিশেষ পত্রিকার ক’জন সাংবাদিকের দ্বন্দ্বের কথা তো সবারই জানা। অবশ্য এটাকে ঠিক “দ্বন্দ্ব” বলা যাবে কিনা বুঝতে পারছি না। কারণ, দ্বন্দ্বে তো দুটো দিক থাকে, তবেই না দ্বন্দ্ব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এক পক্ষ প্রায় এক দশক থেকে একজনের পেছনে পড়ে আছেন। ক্ষমা করবেন পাঠক, একটু চাঁচাছোলা শোনাতে পারে কিছু সম্বোধন বা শব্দের ব্যবহার, কিন্তু বাস্তব চিত্র সত্যিকার অর্থে এরকমই। এ ধরনের “আদাজল” খেয়ে লাগার ঘটনা এই একটাই নয়, অনেকগুলোই আছে। সাধারণ স্পন্সরশীপ ডিল কিংবা কলাম লেখা, না লেখা নিয়েও প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর এ ধরনের দ্বন্দ্বে গণমাধ্যম ব্যবহৃত হয় অস্ত্র হিসেবে। মাঝেমধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়েও চলে যায় সেটা। অনেকে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারেও নিয়ে আসেন এর রেশ। তাদের আলোচনা, সমালোচনা ভীষণ একমাত্রিক। একই কেন্দ্রকে ঘুরে তৈরি হওয়া একাধিক বৃত্ত যেন। যত দূরে যাক বৃত্তের পরিধি, কেন্দ্র একই।

চমস্কি গণমাধ্যমের “সম্মতি উৎপাদনে” পাঁচ ধরনের ফিল্টার বা বায়াসের কথা বলেছেন। এর একটি হচ্ছে “সোর্স” বা “সূত্র”। বড় বড় মিডিয়া হাউজের প্রধান লক্ষ্যই থাকে ডমিনেশন, একচ্ছত্র আধিপত্য সৃষ্টি করা। আর এক্ষেত্রে “ব্রেকিং নিউজ” কালচারটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। “নির্ভরযোগ্য সূত্র”, “একটি সুত্র”, এ ধরনের টার্ম আমরা প্রায়ই দেখে থাকি। “ব্রেকিং নিউজ” প্রতিযোগিতার দুই প্রধান অস্ত্র। কে কার আগে ব্রেকিং নিউজ দিতে পারেন বা কার নিউজের ব্রেকিংযের মাত্রা কতটুকু, সেই প্রতিযোগিতার প্রধান অস্ত্র এই টার্মগুলো। ব্রেকিং নিউজ উৎপাদন করতে গিয়ে কখনো কখনো মিথ্যে “সূত্র” উৎপাদন করে বসেন, কিংবা কখনো কখনো গড়ে উঠে ক্রিকেটারদের সাথে সখ্যতা। এই সখ্যতা নিয়ে ক্রিকেটাঙ্গনে মুখরোচক অনেক ধরনের কথা প্রচলিত আছে। ক্রিকেট কৌতুকেরও একটা অংশ বটে। অনেকে আবার এটাকে “দাওয়াত সংস্কৃতি”-ও বলে থাকেন। ক্রিকেটাররাও এক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের সীমা ভুলে যান এবং পরিচিত গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে অনেক গোপন তথ্য প্রকাশ করে বসেন। ম্যাচের আগের দিন “নির্ভরযোগ্য” সূত্র থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার অনেক তথ্যই আসে ক্রিকেটারদের কাছ থেকে। মাঝে মাঝে অবশ্য এ নির্ভরযোগ্যতা পাল্টা আঘাতও হানে। ব্যক্তিগত আড্ডায় বলা অনেক কথাই চলে আসে গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে। এ ধরনের প্রচারে কতটুকু “কনসেন্ট” আছে বা আদৌ আছে কিনা, সেটা সাধারণ পাঠকেরা কখনো জাজ করেন না। সাংবাদিকরা তাই কখনো বন্ধু হন কিংবা কখনো নিজেরাই জাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যান। ক্রিকেটারদের একটা “ইমেজ” দাঁড় করানোর ভারটা নিজেদের কাঁধে নিয়ে নেন। তাই মাশরাফিকে আমরা যতটা না “ক্রিকেটার” হিসেবে জানি, তারচেয়েও বেশি জানি “সাতটি অপারেশন”, ” তুই পারবি” এ ধরনের শব্দের মাধ্যমে। সাকিবকে জানি “ব্যাড বয়” হিসেবে।

সাংবাদিক হিসেবে গঠনমূলক সমালোচনা করা নিঃসন্দেহে সাংবাদিকদের কর্তব্য। কিন্তু কখনো কখনো তারা নিজেরাই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যান। আর সেটা যখন তাদেরকে “জাজ” এর ভূমিকায় অবতীর্ণ করে কিংবা সাধারণীকরণে উদ্বুদ্ধ করে, তখন তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ক্রিকেটারদের সাথে তাদের এ শত্রুতা কিংবা সখ্যতা সব সীমাকেই তখন অতিক্রম করে যায়। এমনও হয় যে, একজন নির্দিষ্ট ক্রিকেটার সম্পর্কে কোনো খবর পেতে হলে আমরা একজন নির্দিষ্ট সাংবাদিকের উপর নির্ভর করি, তার স্টেটমেন্টের অপেক্ষায় বসে থাকি। কোনো ঘটনা ঘটলে তার ক্ল্যারিফিকেশনের অপেক্ষায় থাকি। কারণ আমরা সবাই জানি, ওই নির্দিষ্ট ক্রিকেটারের খবর আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি দেন ওই নির্দিষ্ট সাংবাদিকই। কারণ তিনিই তাঁর সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। ।

কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার্থে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার্থে বারবার বিতর্ক উস্কে দেওয়ার চেষ্টা, দুটোই নৈতিকতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। যদিও বর্তমান সময়ে নৈতিকতা নিয়ে কথা বলা এক ধরনের বিলাসিতাই। নৈতিকতাকে তাই এখন একটা “মিথ”-ই মনে হয়। কিংবা এমনও হতে পারে, নৈতিকতার সংজ্ঞা এক একেকজনের কাছে একরকম। কারো কাছে তার অবস্থানটাই সর্বাধিক নৈতিক। কেউ বা মোরাল কম্পাসকে ইচ্ছেমত ব্যাসার্ধ টেনে বৃত্ত আঁকেন।

মতামত জানান :