সাউথ আমেরিকা – এই নামটি যদি কেউ বলে তাহলে আমরা হয়ত কোন ফুটবলার বা ফুটবলের কোন গল্প শোনার আশা করি। তবে, মাহাইকা নদী যেখানে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে মিশেছে তার পাশের গ্রামের এই গল্পটা ফুটবল নিয়ে নয়। গল্পটা খেমরাজ এবং তার স্বপ্নের।
ব্রিটিশরা যেমন আমাদের এই উপমহাদেশে শাসন করে গেছে। ঠিক একই ভাবে আটলান্টিক পাড়ের দ্বীপ দেশগুলোও শাসন করেছে। সেই দ্বীপগুলো পরবর্তীতে দেশে রূপান্তর হয়। গায়ানা তেমনই একটা দেশ। গায়ানা বা এর আশেপাশের দ্বীপগুলো ব্রিটিশ শাসনের সময় জনাকীর্ণ ছিল। তাই চাষবাস করার জন্য উপমহাদেশের মানুষদেরকে ব্রিটিশরা সেখানে নিয়ে যেতে থাকে। আস্তে আস্তে সেই সব উপমহাদেশীয় লোক তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে নেয় সেই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে। গড়ে উঠে নতুন জাতিসত্তা। পুরো ক্যারিবীয় অঞ্চলের সেই জাতিসত্তার লোকদেরকে বলা হয় ইন্দো-ক্যারিবীয়। আর গায়ানিজদের বেলায় তা হয়ে যায় ইন্দো-গায়ানিজ।
খেমরাজ ছিলেন তেমনই একজন। তার মনে গায়ানা বাস করলেও দেখতে উপমহাদেশের সাধারণ বাসিন্দাদের মত ছিলেন। পেশায় জেলে খেমরাজ সারাদিন মাছ ধরতেন আর তার সহধর্মিণী উমা তা বাজারে বিক্রি করতেন। বাকিটা সময় কাটাতেন আর দশটা গায়ানিজ মানুষের মতই হৈ-হুল্লোড়ে। আর নেশা ছিল ক্রিকেটের। তাদের গ্রামের ক্রিকেট দলটা নিয়েই আগাবে গল্প।
কয়েকদিন ধরেই খেমরাজ লক্ষ্য করছে যে, তাদের ক্লাবের ছেলেরা রান পাচ্ছে না। ব্যাপারটা গভীর চিন্তায় ফেলে দেয় তাকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন তার ছেলেকে ক্রিকেটের তালিম দিবেন।
বেশী সাত-পাঁচ না ভেবে নেমে পড়লেন ছেলেকে নিয়ে। তবে ভাল মত প্র্যাকটিস করাতে চাই ক্রিকেট সামগ্রী। আর তার জন্য চাই টাকা। তবে সেই সময়টাতে গায়ানার অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার কারণে দেশের মানুষের কাছে তেমন টাকা ছিল না। সেই জোয়ার খেমরাজের পকেটেও এসেছে। তাই ছেলের জন্য সামগ্রী কিনতে চাইলেও তার উপায় ছিল না। একবার চিন্তা করলেন যে কারও কাছ থেকে ধার করে হলেও ছেলেকে ক্রিকেটের বিভিন্ন সামগ্রী কিনে দিবেন। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় তা আর করলেন না।
প্যাডের আদলে ছেলের পায়ে পরিয়ে দিলেন কাঠ দিয়ে বাঁধানো বিশেষ ধরনের প্যাড। আর ব্যাট যেটা ছিল সেটার হাতলও ছিল বাঁশ দিয়ে বাঁধা। এত সব অপ্রাপ্তির পরেও ছেলেটা অল্পতেই ক্রিকেটের সব বেসিক শিখে ফেলেছে। তার সাথে নিজে নিজেই আরও নতুন কিছুর চেষ্টা করছে। তাইতো অল্প সময়েই ইউনিটি গ্রামের ক্লাবে ছেলেটি নিয়মিত খেলতে লাগল।
ইউনিটি – এটা আসলে একটা গ্রামের নাম। স্বাধীন গায়ানার গ্রাম গুলোর নাম এমন সহজ-সরল হয়ে থাকে। ইউনিটি গ্রামের ক্রিকেট ক্লাব যা ইউনিটি ক্রিকেট ক্লাব নামে পরিচিত। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা আনন্দ ফুর্তি করতে অনেক ভালবাসে। সেই গ্রামটাতেও তার বিপরীত ছিল না। তাদের আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে যেত যখন তাদের ক্লাবের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইয়াং স্টারদের বিপক্ষে কোন ম্যাচ আয়োজন করা হত। মিউজিক ব্যান্ড আনা হত। মাঠের আশে পাশে মেলার মত হয়ে যেত। কিন্তু ছেলেটা ছিল খুব লাজুক। হাসিটা তার মুখে লেগে থাকলেও তার মুখ দিয়ে কথা বের করা ছিল দায়। তবে মাঠে ছিল তার বিপরীত। ব্যাট কথা বলত তার হয়ে। তাইতো উৎসবের সব আলো কেড়ে নিতেন সেই।
এই জন্যই বেশীদিন স্থায়ী হল না তার এবং ইউনিটি ক্লাবের যাত্রা। না তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি হয়ে গেলেন গায়ানা ক্রিকেট ক্লাবের সদস্য। গায়ানা ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ বোরদা। সেই ৯০ এর দশকেই মাঠটি ছিল প্রায় শতবছরেরও চেয়ে পুরোনো। সেই ছেলেটি কি তখন এত চাপ নিতে পারবে?এমনই ভেবেছিল গায়ানা ক্রিকেট ক্লাব কর্তৃপক্ষ। তাইতো তাকে সবসময় আগলে রেখেছে। ঠিক যেন ছেলের মত করে।
ইউনিটি গ্রাম, ইন্দো-গায়ানিজ, গায়ানা ক্রিকেট ক্লাব আর বাবার নাম খেমরাজ। কি কারও সাথে মিল খুজে পাচ্ছেন? হুমম, শিবনারায়ণ চন্দরপল। ভিন্ন ধারার ব্যাটিং স্টান্স এর কারনে যিনি সবসময় অন্য সবার থেকে আলাদা ছিলেন।
২.
২০১৫ সালের মার্চের পর আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট দলে সুযোগ মেলেনি তাঁর। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা নিজের সর্বশেষ সিরিজে তিন টেস্টের ৬ ইনিংসে করেছিলেন মাত্র ৯২ রান! ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৫১.৩৭, সেখানে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের পর খেলা ৬ টেস্টে গড় মাত্র ১৬.৬৩।
বয়স ছিল ৪২ ছুঁই ছুঁই । তারপরও আরও কিছুদিন অপেক্ষা করেছেন, যদি আবারও ডাক আসে। শেষ বারের মত। একটা সময় তিনি যার ছায়া হয়েছিলেন সেই লারা অবসর নিয়েছেন প্রায় এক দশক হয়। এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী শচীন, পন্টিংরাও চলে গেছেন। দ্রাবিড়তো কোচিংয়ের পথ বেছে নিয়েছেন। তার ছেলেও খেলে ফেলেছে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ। তাই হয়ত অপেক্ষাটা আরও দীর্ঘতর করেন নি।
৮৭ রানের আক্ষেপ নিয়েই বলে দিলেন বিদায়। ৮৭ রান করলে হতেন ক্রিকেটের বরপুত্র লারাকে টপকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্টে হয়ে সর্বোচ্চ রানের মালিক। কিন্তু এত কিছু ভাবার সময় তার ছিল না। ব্যাটিং করা ছাড়া আর কিছু যিনি ভাবেননি তার এত কিছুর চিন্তা তার কাছে শোভা পায় না। তাইতো অবসর নিয়েই আবার নেমে পড়েন গায়ানার হয়ে খেলতে ঘরোয়া ক্রিকেটে। যেখানে তার অপর পাশে ব্যাটিং করত তার ছেলে, ত্যাজনারায়ণ।
ক্যারিয়ারে কোন সময়ই ছিলেন না পাদপ্রদীপের আলোয়। কিন্তু, তাতে কি! তার কাজটা তিনি করে গেছেন নিজের মত। তার পরিসংখ্যান অন্তত তার হয়ে কথা বলে।
চন্দরপল ১৬৪ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে ৩০টি শতক এবং ৬৬টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫১.৩৭ ব্যাটিং গড়ে ১১,৮৬৭ রান সংগ্রহ করেছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকদের তালিকায় তার অবস্থান অষ্টম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে দ্বিতীয়।
ওয়ানডেতে ২৬৮ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ১১টি শতক এবং ৫৯টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৮,৭৭৮ রান করেছেন। যা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান। ৪০ বার নট আউট থাকার কারণে তার ব্যাটিং গড় ছিল ৪১.৬০।
টি-টোয়েন্টি ঠিক তার সাথে যায় না। তারপরও ২২ টি-টোয়েন্টিতে ২০.২ গড়ে ৩৪৩ রান। স্ট্রাইক রেটটা যদিও ১০০ পার হতে পারে নি।
৩.
১৫ বছর বয়সী চন্দরপল যখন গায়ানা ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতেন তখন সে খুব শুকনা ছিল। গায়ানার আঞ্চলিক ভাষায় শুকনাকে বলে ফাইন (fine)। তো ক্লাব প্রেসিডেন্ট রুডি প্রেরসাদ তাকে মাঠের পাশে এক জিমে নিয়ে গেল। জিম মালিককে প্রেসিডেন্ট বলল যেন, তারা যাতে চন্দরপলকে ভাল মত ট্রেনিং করায়। ট্রেনিংগুলো মনে হয় এক্সট্রিম লেভেলের ছিল। সেই ট্রেনিং থেকেই তিনি পেয়েছেন জীবনীশক্তি। যার ফলাফল ২২ বছর তিনি ছুটেছেন রানের পিছনে।
শিবনারায়ন চন্দরপল- আপনি যদি ক্রিকেট প্রেমী হন তাহলে এই নামটি শুনার সাথে সাথেই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে অদ্ভুত ধরনের ব্যাটিং স্টান্সের বাঁহাতি একজন ব্যাটসম্যানের প্রতিচ্ছবি। সৌম্য, শান্তভাবে হেঁটে চলছেন ক্রিজের দিকে। ক্রিজে পৌছে উইকেটের বেল নিয়ে তার পজিশন সেট করলেন। তারপর বল আসার জন্য ব্যাটিং স্টান্স নিলেন। সেই মুহূর্তে তার কাজ যেন শুধু একটাই। অন্তত চোখগুলো সে কথাই বলে, watch the ball, watch the ball.
না; বোলারদের কাছে তিনি ভিলেনের মর্যাদা পাননি। তিনি বোলারদের পাশ কাটিয়ে শুধু নিজের কাজটিই করে গেছেন। ক্যারিবিয়ান সাগরে আসুক না নতুন কোন সাইক্লোন কিংবা জর্জটাউনের রাজনৈতিক পাড়ায় পরিবর্তনের সুর বাজছে। তার সেদিকে কোন খেয়াল নাই, তার কাজ শুধু একটাই। হয়ত আপনার কাছে তার ব্যাটিং দেখে বিরক্ত লাগবে, মাঠের দর্শকদেরও। তার ব্যাটিং আপনাকে মুগ্ধ করুক আর না করুক তবুও তার ব্যাটিং স্মরণ করিয়ে দেয় ক্রিকেটের আভিজাত্যকে। তার কাভার ড্রাইভগুলো হয়ত অন্য কারও মত প্রফুল্লতা দেয় না। কিন্তু, সদ্য একাডেমিতে ভর্তি মনে প্রাণে বড় ক্রিকেটার হবার বাসনা সহিত একজন তরুণ ব্যাটসম্যান সেই শটে খুজে পাবে অনুপ্রেরণা।
১৭ মার্চ ১৯৯৪। জর্জটাউনের বোরদা স্টেডিয়াম। কর্নারস্টোন নামে পরিচিত এই স্টেডিয়ামটি জর্জটাউন ক্রিকেট ক্লাবের হোমভেন্যু। মানে চন্দরপলেরও হোমভেন্যু। সেই মাঠেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আতিথ্য দিবে ইংল্যান্ডকে। টেস্ট ইতিহাসের ১২৫৪ নম্বর টেস্ট। ১৯ বছরের চন্দরপলের অভিষেক ম্যাচ। হেংলা-পাতলা ব্যাটসম্যানটি অবশ্য সে টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইংলিশদের বিপক্ষে বনে গেলেন বোলার। করলেন ১৬ ওভার যদিও উইকেট পাননি। তারপর টেস্টের তৃতীশ দিন নামলেন ব্যাটিংয়ে। করলেন ১৩৫ বলে ৬২ রান।
তিনি যখন ৫০ রানে পৌছালেন তখন হেলমেট খুললেন উদযাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু গ্যালারিতে বসে থাকা তার মা আর বোন যেন তার চেয়ে বেশী খুশি হয়েছিল। আর বোরদা স্টেডিয়ামটা অনেক খোলামেলা ছিল ফলে খেলা দেখতে আসা অনেকেই ডুকে যেত মাঠের মধ্যে। তেমনিই তিনজন ডুকে গিয়েছিল চন্দরপলের ফিফটির পর। তাকে তারা জড়িয়ে ধরে। অনেক ক্ষন জড়িয়ে ধরার পরও না ছাড়লে তিনি ছাড়াতে চেষ্টা করেন। তারপরও তারা ছাড়েননি। ঠিক যেমনভাবে পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সাথে তিনি আটকেছিলেন ২২ টি বছর।
তবে ক্যারিয়ারের শুরুতে তার এভারেজ এবং পারফরম্যান্স ঠিক চন্দরপল স্বরূপ ছিল না। পুরো ক্যারিয়ারে যেখানে তার ৩০ টি সেঞ্চুরি সেখানে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত খেলা মোট ৪৯ টি টেস্টে তার সেঞ্চুরির সংখ্যা ছিল মাত্র ২ টি। বিপরীতে ফিফটি ছিল ২২ টি। মানে বেশীরভাগ সময়েই বড় ইনিংস খেলতে পারতেন না। ফলে গড়ও ছিল ৪০ এর নিচে। এরমধ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ পর্যন্ত খেলা ২৫ টি টেস্টে তার গড় ছিল মাত্র ৩১.৪৩।
তবে ২০০২ সাল থেকে তার বড় ইনিংস খেলার হার বাড়তে থাকে। সেই বছর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি মোট ৫২ টি টেস্ট খেলেন। এই ৫২ টেস্টে ৫০ এর উপরের গড়ে রান করেন। সাথে ছিল ২৮ টি ফিফটি এবং ১২ টি সেঞ্চুরি। এই সময়ে তার খেলা অন্যতম দুটি ইনিংস হল ৬৯ বলে সেঞ্চুরি এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪১৮ রান তাড়া করতে গিয়ে সেঞ্চুরি।
২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি লারাকে তার ব্যাটিং পার্টনার হিসেবে পেলেও লারার অবসরের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে একমাত্র গেইল ছাড়া আর কোন ভাল মানের ব্যাটসম্যান ছিল না। তবে গেইলও ২০০৮ সালের পর থেকে জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন না। এত কিছু সত্বেও ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার গড় ছিল অবিশ্বাস্য। এই সময় তিনি ৫২ টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন। তার মধ্যে ৮০ ইনিংসে ৭০.৫১ গড়ে করেন ৪১৬১ রান। যেখানে ছিল ১৪ টি সেঞ্চুরি এবং ২১ টি ফিফটি। আর পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বাকি প্লেয়াররা এই সময় টেস্টে খেলেন ৫৯০ ইনিংস। সেখানে ৩১.৬৭ গড়ে করেন ১৭,৮৮৯ রান। মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের প্রতি ৫ রানের মধ্যে ১ রানই তিনি করেছেন। যদি তার সাথে ভাল মানের আরো কিছু ব্যাটসম্যান থাকত তাহলে বলাই যায় তার রান আরো বাড়ত।
চন্দরপল টেস্টে মোট ৪৬ বার অপরাজিত ছিলেন। কোন স্বীকৃত ব্যাটসম্যানের জন্য এই সংখ্যাটা সর্বোচ্চ। যদিও তার সাথে নাম রয়েছে আরেক গ্রেট অস্ট্রেলিয়ান স্টিভ ওয়াহর। অপরাজিত হওয়ার সংখ্যাটা থেকে তার পার্টনার সঙ্কট আবারে সামনে এসে পড়ে। আরো একটা বিষয় দিয়ে তার ব্যাটিং মাপা যায়। তা হল বল খেলার সংখ্যা। টেস্টে তিনি মোট ২৭,৩৯৫ বল খেলেছেন। যা টেস্ট ইতিহাসের চতুর্থ সর্বোচ্চ। এছাড়াও ক্যারিয়ারের বেশীরভাগ সময়ই তিনি ব্যাট করেন ৫ এবং ৬ এ। যেখানে তিনি ৯,০০০ এর উপরে রান করেন। শুধুমাত্র স্টিভ ওয়াহই ৫ এবং ৬ এ ব্যাট করে নয় হাজারের অধিক রান করেছেন। যদি ৩ এবং ৪ এ রেগুলার খেলতেন তাহলে হয়ত তার রান আরে বাড়ত। যদিও ৩ এবং ৪ এ তার গড় মাত্র ৩৪। এর পিছনে কারন হতে পারে তিনি এই পজিশনে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বেশী খেলেছেন। তবে একটা জিনিস সবাই মানবে, তিনি যদি তার সেরা সময়ে অন্তত ৪ নম্বরে খেলত তাহলে তার সেঞ্চুরির সংখ্যা আরো বেশী হত।
ওয়ানডেতে চন্দরপল
যদিও চন্দরপলকে মনে করা হয় একজন টেস্ট ব্যাটসম্যান বা রক্ষণাত্মক মানসিকতার ব্যাটসম্যান হিসেবে। তারপরও ওয়ানডেতে তিনি বেশ সফলই। ২৫১ ইনিংস খেলে ১১ সেঞ্চুরি আর ৫৯ ফিফটিতে করেন ৮৭৭৮ রান। গড় ৪১.৬০ এবং স্ট্রাইক রেট ৭০.৭৬। স্ট্রাইক রেট খুব বেশী না হলেও তার সময়ে এটাকে পর্যাপ্ত হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। রাহুল দ্রাবিড়ের ওয়ানডে স্ট্রাইক রেট হল ৭১.২৫। সে হিসেবে তার টা খারাপ না। তাদের তুলনা করলাম কারণ দুজনেই এক মানসিকতার প্লেয়ার। তার উপরে ওয়েস্ট ইন্ডিজে কিছু পিচ এমন আছে যেগুলো অনেক স্লো থাকে, উপমহাদেশের তুলনায়ও।
ওয়ানডেতে তার ক্যারিয়ার পর্যালোচনা করলে আরেকটা বিষয় দেখা যায় যে, তিনি এক পজিশনে রেগুলার ব্যাটিং করেননি। কখনো ওপেনিংয়ে, কখনও চারে বা পাঁচে এভাবে তার পজিশন বদল হয়েছে। তবে ওপেনিংয়ে তিনি বেশ সফলই বলা যায়। ওপেনিংয়ে ৭৭ ইনিংস ব্যাট করে ৪৩.৩৭ গড়ে করেন ২৯৪৯ রান। সেঞ্চুরি ৭ টি এবং হাফ সেঞ্চুরি ১৮ টি। এরমধ্যে রয়েছে একটি ১৫০ এবং আরেকটি অপরাজিত ১৪৯ রানের ইনিংস। ওপেনিংয়ে ছাড়াও তিনি ওয়ানডেতে তিনে ২৮ ইনিংস, চারে ৫৪ ইনিংস, পাঁচে ৬৪ ইনিংস এবং ছয়ে ব্যাট করেন ২২ ইনিংস। তার মানে এটা পরিষ্কার যে তিনি কখনই রেগুলার এক পজিশনে বেশি দিন ব্যাট করতে পারেননি। আবার হোমেও বেশী ম্যাচ খেলতে পারেননি। যদিও তার হোম এওয়ে রেকর্ড প্রায় সমানই। হোমে ৮৪ ইনিংসে ৪১.৮০ গড়ে রান করেন ২৯২৬, সেঞ্চুরি ৫ টি এবং হাফসেঞ্চুরি ২০ টি। এ্যওয়েতে ১৬৭ ইনিংস ব্যাট করে ৪১.৫০ গড়ে করেন ৫৮৫২ রান। ৬ টি সেঞ্চুরির সাথে আছে ৩৯ টি হাফসেঞ্চুরি। আরেকটা জিনিস যা তার চোখে পড়ার মত তা হল তিনি ওয়ানডেতে মাত্র ২২ বার বোল্ড হয়েছেন। ৭৭ ইনিংসে ওপেন করে ২২ বার বোল্ড হওয়া খুব কমই বলতে হবে। এক্ষেত্রে যদি রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে তুলনা দেই তাহলে দ্রাবিড় ৩১৮ ইনিংসে বোল্ড হন ৫৭ বার। যা তার ক্যারিয়ারের আউট হওয়ার ২০ শতাংশ। এসব থেকে চন্দরপলের সলিড টেকনিক সম্পর্কে ধারনা নেওয়া যায়।
সংক্ষিপ্ততম ফর্মেটে চন্দরপল
চন্দরপলকে ঠান্ডা মানসিকতার ব্যাটসম্যান হলেও হলেও তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ধুমধাড়াক্কা ক্রিকেট টি-টোয়েন্টি ও খেলেন। এছাড়া, আইপিএলের মত আসরেও তিনি সুযোগ পান। যদিও এক্ষেত্রে ভারতে তার ব্যাটিং সাফল্য কথা বলতে হবে। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় কপিবুক ব্যাটিংয়ের পুজারি হলেও তিনি শেষ সময়ে কেভিন পিটারসনের মত সুইচ হিটও খেলেছেন। এমনকি ছয়ও মেরেছেন।
কালো স্টিকারের রহস্য
ক্যারিবিয়ান অঞ্চল সমুদ্র কিনারায় হওয়ার এখানে আদ্রতা বেশী হয়। আমরা কক্সবাজারে গেলে যেমন চেহারা জ্বলে যায় আদ্রতার কারনে ঐখানকার মানুষও একই সমস্যা ফেস করে। যেহেতু পুরো অঞ্চলটাই এমন তাই ঐ সমস্যা থেকে বাঁচতে তারা বিভিন্ন রকমের ফর্মুলা আবিষ্কার করে। তার মধ্যে রোদচশমা বা সানগ্লাস জনপ্রিয়। আর চোখের নিচে কালো স্টিকারও সানগ্লাসের মতই কাজ করে। এটি চোখকে রোদের তাপ থেকে শীতল রাখে।
চন্দরপল এই উপায় তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই করে আসছেন। এক্ষেত্রে muller নামে একটি ব্রান্ড তাকে স্পন্সর করেছে। যদিও ২০১১ বিশ্বকাপে আইসিসির ব্যবসায়িক নিয়মের পরিপন্থী হওয়ায় তাকে এই ব্রান্ডের স্টিকার ব্যবহারে নিষোধজ্ঞা দেওয়া হয়। তার পরতো আর ওয়ানডেই খেলেন নি।
ছেলের সাথে ক্রিজ শেয়ার করা
২০১৬ সালে তাকে জাতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হলেও তিনি তখন ঘরোয়া ক্রিকেটে মন দেন। সেখানে ২০১৮ সাল পর্যন্ত খেলেন। এরমধ্যে তিনি যখন ব্যাটিংয়ে নামতেন তখন দেখা যেত তার মত আরেকজন অপরপ্রান্তে আছেন। ঠিক হুবহু তার মত! নাম ত্যাগনারায়ণ চন্দরপল। শিবনারায়নের ছেলে। ২০১৪ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সদস্য ছিলেন। বাবার সাথে খেলেছেন বেশ কয়েকটি ম্যাচ। আর গায়ানা দলের নিয়মিত সদস্য। হয়তবা নিকট ভবিষ্যতে দেখা যাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলেও তার অভিষেক হয়েছে। তখন চন্দরপল আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে! এ বলে থমকে যেয়েন না।
আন্তজার্তিক ক্রিকেটে ২২ বছর ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের প্রতিনিধিত্বকারী চন্দরপলের তার অতিমানবিক পরিসংখ্যানের পাশাপাশি রেকর্ডের পাল্লা ভারী থাকবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সেইখান থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য রেকর্ড হল,
টেস্টে সর্বোচ্চ বল খেলার দিক দিয়ে চতুর্থ অবস্থানে আছেন তিনি। ১৬৪ টি টেস্টে খেলেন ২৭৩৯৫ টি বল। তার আগে রয়েছে যথাক্রমে রাহুল দ্রাবিড়, শচীন টেন্ডুলকার এবং জ্যাক ক্যালিসের নাম। তাদের সবাই চন্দ্ররপল থেকে বেশী রান করেছেন।
টেস্টে রান তালিকায় তার অবস্থান ৮ নম্বরে। মাত্র ৮৭ রানের জন্য টপকাতে পারেননি ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের রের্কডকে। তাই তাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট ইতিহাসের ২য় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
টেস্টে তিনি ৯৬ টি পঞ্চাশের অধিক রানের ইনিংস খেলেন। মাত্র চার জন তার চেয়ে বেশী পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলেছেন। আর টেস্টে তার করা ৩০ সেঞ্চুরি, টেস্ট ইতিহাসের ১৪ তম সর্বোচ্চ।
টেস্টে তার হাঁকানো ১২৮৫ টি চার, টেস্টে ইতিহাসে বাউন্ডারির ক্ষেত্রে ৯ম সর্বোচ্চ। আর তিনি টেস্টে ছয় মারেন ৩৬ টি। আর ওয়ানডেতে চারের সংখ্যা ৭২২ টি এবং ছয় ৮৫ টি। সর্বোচ্চ বাউন্ডারি হাকানোদের তালিকায় ওয়ানডেতে তার অবস্থান ২৪ নম্বরে। এছাড়াও, ওয়ানডে তথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে তিনিই একমাত্র যে কিনা চেজ করতে গিয়ে শেষ বলে ছয় মারে, যখন জয়ের জন্য ঠিক ছয় রানই দরকার ছিল। ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতে তিনি এই কীর্তি গড়েছেন।
২০০২ সালে সে ভারতের বিপক্ষে ১৫১৩ মিনিট আউট না হয়ে ব্যাট করেন। সবচেয়ে বেশী সময় ধরে অপরাজিত থাকার রেকর্ড এটি। এই সময় তিনি ১০৫১ টি বল ফেস করেন। যা সর্বোচ্চ বল ফেস করে নটআউট থাকার রেকর্ড।
চন্দরপল ২০০৪ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে দুই ইনিংসে ১২৮ এবং ৯৭ রানে অপরাজিত থাকেন মানে দুই ইনিংস মিলিয়ে করেন ২২৫ রান। দুই ইনিংস মিলিয়ে টেস্টে ব্যাটিং করতে নেমে অপরাজিত থেকে পরাজয়ের স্বাদ পাওয়াদের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ রান।
টেস্টে উভয় ইনিংসে ৯ বার একই বোলার তাকে উভয় ইনিংসে আউট করেন। এই ক্যাটাগরির মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ।
চন্দরপলকে আমরা সবাই রক্ষণ্মাত্বক ব্যাটসম্যান হিসেবে জানলেও টেস্টে তার রয়েছে ৬৯ বলে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড। ২০০৩ সালে জর্জটাউনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনি এই কীর্তি গড়েছেন। যা টেস্ট ইতিহাসের ৬ষ্ঠ দ্রুততম সেঞ্চুরি।
টেস্টে তার ৪৬ বার নটআউট থাকা টেস্ট ইতিহাসের ৮ম সর্বোচ্চ। আর স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ২য় সর্বোচ্চ।
টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করে রান করাটা বলতে গেলে অনেক কঠিন কাজ। চন্দ্ররপল সেখানেও দেখিয়েছেন কৃতিত্ব। ৪৯ ইনিংস ব্যাট করে ৪১.৫৮ গড়ে করেন ১৫৮০ রান। রয়েছে ২ টি সেঞ্চুরির সাথে ১১ টি ফিফটি। আর টেস্ট ইতিহাসে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এর তালিকায় তার অবস্থান ৪ নম্বরে।
- চন্দরপলের ক্যারিয়ার সেরা টেস্ট ইনিংস
- ২০১১ সালের ৬ জুলাই ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১১৬ (তার ভাষ্যমতে তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস)
- ২০০২ সালের ৩০ শে অক্টোবর ভারতের বিপক্ষে ১৪০
- ৩১ শে মার্চ ২০০৫ সালে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে অপরাজিত ২০৩
- ৯ মে ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০৪(টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডের সময় এই ইনিংসটি খেলেন)
- ২৭ শে মার্চ ১৯৯৭ সালে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১৩৭
- ওয়ানডেতে চন্দরপলের সেরা ইনিংসগুলো
- ২১ জানুয়ারি ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১৪৯ রান (তিনশতাধিক রান তাড়া করতে গিয়ে চন্দ্ররপল ওপেনিং থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রিজে থেকেও দলকে জয় এনে দিতে পারেননি। যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয়ী হত তাহলে কোন সন্দেহ ছাড়াই এটি হত ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস)
- ২৪ জানুয়ারি ১৯৯৯ সালে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৫০ (ওয়ানডে ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ)
- ৪ জুলাই ২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতে অপরাজিত ১১৬
- ১৮ আগস্ট ২০০১ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৮৭
- ৩ জানুয়ারি ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭৭
তার আরেকটি বিখ্যাত ইনিংস আছে। তা হল ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৬২ বলে ৬৩। সেই ইনিংস সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত দেওয়া হল,
২ বলে দরকার ১০ রান। মানে এক বলে ৪ আর অপর বলে ৬ রান নিতে হবে। সেই মুহূর্তে আপনি কাকে ব্যাটিংয়ে নামাবেন। ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল কিংবা বেন স্টোকস! আর অনেকেই হতে পারে। তবে শিবনারায়ণ চন্দরপল! আপনার যদি ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা থাকে তাহলে ঐ মুহূর্তে আপনি তার কথা ভাববেন না। কিন্তু আশ্চর্য জনক হলেও সত্যি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি শেষ ২ বলে ১০ রান নিয়ে দলকে জয়ী করেছেন। শেষ বলে জয়ের জন্য ঠিক ৬ রান লাগে, তিনি সেই প্রয়োজনীয় ৬ রান মেরে দলকে জয়ী করেছেন। ৯ এপ্রিল ২০০৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১ম ওয়ানডেতে তিনি এই দুঃসাধ্য কাজ সাধন করেছেন।
২২ বছরের বর্ণিল এক ক্যারিয়ারে তার অর্জন অনেক। কিন্তু তাকে নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়। এ নিয়ে তার কোন আফসোস নেই। সিডনি মর্নিং হেরাল্ড তাকে নিয়ে মনে যথাপোযুক্ত বলেছে,
Chanderpaul is reserved, not loud, effective rather than spectacular, consistent rather than brilliant. He is known most for his crabby, face-on stance, in which he faces the bowler “like a tennis player returning a serve”, and lurches into a more conventional position as the ball is flung at him. He has a broad range of shots, but in order to make the most runs, he shelves many of them.
বর্তমান সময়ে যারা টেস্ট এর উপযুক্ত ব্যাটসম্যান তারা সচরাচর তেমন ওয়ানডে খেলেন না। ভবিষ্যতে তিন ফরম্যাটে ভিন্ন রকম স্কোয়াড নিয়ে খেলা হবে তা আচঁ করা যায়। তাই বলা যায় যে, শচীন টেন্ডুলকারের মত কিংবা লারার মত কোন ব্যাটসম্যান হয়ত খোলস পাল্টে আবার ক্রিকেটে আসবে। কিন্তু চন্দরপলের মত ব্যাটসম্যানকে আর দেখা যাবে না ওয়ানডেতে। ভক্তরা কতটুকু তার মত কাউকে মিস করবে জানি না তবে ক্রিকেট অবশ্যই তার মনোযোগী ছাত্রকে মিস করবে।