১৩ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

কেন উইলিয়ামসন; ক্রিকেটের ব্যতিক্রমী এক চরিত্র

প্রতিবেদক
Arfin Rupok
শনিবার, ৮ আগস্ট , ২০২০ ৯:১৪

তিনি ঠান্ডা মাথার খুনি; দলের প্রয়োজনে কখনো ব্যাট হাতে আবার কখনো বুদ্ধিদীপ্ত ক্যাপ্টেন্সিতে নায়ক বনেছেন ক্রিকেট মাঠে। কঠিন পরিস্থিতিতেও ঠান্ডা মাথায় এগিয়েছেন; হেসেছেন বিজয়ের হাসি। তিনি যে বিশ্ব ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের ধ্রুবতারা। আবার অনেকের কাছে ধৈর্য্যশীল একজন অধিনায়ক। একা হাতে দলকে নিয়েছেন বিশ্বমঞ্চের ফাইনালে। ছক্কা হাঁকিয়ে দলকে জিতিয়ে করেছেন নীরব উদযাপন! আবার কখনোবা দুর্দান্ত ক্যাপ্টেন্সিতে ভারতকে হারিয়ে জানান দিয়েছেন নিজের শক্তিমত্তার। দিনশেষে তিনি খুব কাছে গিয়েও ছুঁয়ে দেখতে পারেননি স্বপ্নের বিশ্বকাপ ট্রফি। তাতে কি? নামের পাশে যেই অবদান যুক্ত করেছেন সেটাই বা কম কিসে? বাদামী দাঁড়িওয়ালা এই মানুষটি যে কোটি ভক্তের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।

এই মানুষটির ধৈর্য্যশীলতা আমাকে সহ সবাইকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে কঠিন পরিস্থিতিতে দলকে এগিয়ে নেওয়ার টেকনিক। কোটি ভক্তের হার্টবিট যখন কাঁপতে থাকে তখন এই মানুষটি ঠান্ডা মাথায় দলকে দিয়ে যান নিজের সেরাটা। কখনোবা ছক্কা হাঁকিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করে দলকে নিয়ে যান সেরা অবস্থানে। তবুও নেই কোনো রাজকীয় উদযাপন! শুধু মাত্র মাথার হেলমেট খুলে সতীর্থের সাথে আলিঙ্গন কিংবা সাদামাটা উদযাপনেই সমাপ্তি ঘটান দারুণ সব সাফল্যের গল্পের৷ দিনশেষে তাকে কাপ্তান কুল বা কুল ফিনিশার বললেও হয়তো ভুল হবেনা!

এতোক্ষণে বুঝে গেছেন আজকের গল্পটা কাকে নিয়ে? হ্যাঁ, আজকের গল্পটা আধুনিক ক্রিকেটের বেমানান এক চরিত্র নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র কেন উইলিয়ামসনকে নিয়ে। আসুন এবার একজন উইলিয়ামসন বা একজন ঠান্ডা মাথার মানুষকে নিয়ে কিছু জানা অজানা গল্প জানতে থাকি।

—–

‘Please bowl to me, Dad.’

বয়সটা তখন সবে মাত্র ৩ বছর। বাবার সাথে ঘরে বসে টিভি দেখতে থাকা ছোট্ট ছেলেটির নজর পড়লো ঘরের কোণে থাকা ক্রিকেট ব্যাটের দিকে। সেই ৩ বছর বয়সেই ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে পড়লেন ছেলেটি; বোলার স্বয়ং বাবা। ঘরের কোণের ছোট্ট জায়গায় ব্যাট হাতে দারুণ সব ডিফেন্স আর ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটিংয়ে মুগ্ধ হয়েছিলো ঘরোয়া ক্রিকেট মাতানো বাবা। সেই থেকেই ক্রিকেটে পথচলা শুরু। সেদিনের ছোট্ট ছেলেটি আজ মস্ত বড়ো ক্রিকেটার!

কেন উইলিয়ামসন; যেকোনো পরিস্থিতিতেই অল্প সময়েই মানিয়ে নিতে পারা একজন চরিত্রের নায়ক। সেই ছোট বেলায় রাগবি মাতানো কিশোর আজ নিউজিল্যান্ডের সেরা ক্রিকেটারের একজন। ইচ্ছে শক্তি, সাহস কিংবা অধ্যবসায় ছাড়া তো এতোকিছু সম্ভব নয়। এই যাত্রায় একজন সফল মানুষ হিসেবেই ধরা যায় উইলিয়ামসনকে!

পরিণতি বোধ কিংবা ঠান্ডা মেজাজ; এই দুইটা চরিত্রের সাথে যেই নামগুলো আসবে সেখানে উপরেই থাকবে উইলিয়ামসনের নাম। কিন্তু এইসব তো হঠাৎ করে আসেনি, সেই ছোট্ট বেলা থেকেই এই গুণের অধিকারী ছিলেন নিউজিল্যান্ডের তারকা ক্রিকেটার। সেই ছোট বেলায় খেলার সুযোগ করে দিতেন সতীর্থদের। ছোট্ট উইলিয়ামসনের এমন কারসাজি দেখে স্বয়ং বাবা অবাক হতেন। আর এখন অবাক হচ্ছেন কোটি ক্রিকেট ভক্ত।

—–

মাত্র ৩ বছর বয়সে ব্যাট হাতে তুলে নেওয়া ছেলেটি সময়ের সাথে সাথে আসক্ত হন ক্রিকেটে। ছোট বেলায় ব্যাটিং নিয়ে কাজ করতে থাকেন কোচ জোস সিমসের অধীনে। সেই সময় উদীয়মান দলের হয়ে চমকে দেন সবাইকে। শুধু তাই নয়, একদিন ৬০ রানের ইনিংস খেলে দলকে এনে দেন ম্যাচ জয়ের স্বাদ। বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করতে থাকা উইলিয়ামসের সুযোগ হয় ঘরোয়া ক্রিকেট মাতানোর।

সময়টা ২০০৭ সাল; নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্টসের হয়ে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। সেই থেকেই বড় মঞ্চে আগমন। এরপর আর পিছনে ফিরতে হয়নি তাকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের সেরাটা দিয়ে মন জয় করেন নির্বাচকদের। জায়গা করে নেন নিউজিল্যান্ডের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে। সেই সাথে পেয়ে যান অধিনায়কত্ব! একবার কি ভেবেছেন? সেই ছোট বেলা থেকেই দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসা মানুষটি কি এতো সহজে হাল ছেড়ে দিবেন! না, তা তো হয়না। তাইতো নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ ছুটছেন আপন মহিমায়।

—–

এভাবেই ক্রিকেট মাঠে উত্থান ঘটতে থাকে উইলিয়ামসনের। ঘরোয়া ক্রিকেট মাতানো ছেলেটির সুযোগ হয় নিউজিল্যান্ডের জার্সিতে মাঠ মাতানোর। সময়টা ২০১০ সাল; রঙ্গিন পোশাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখেন তিনি। এরপর টেস্ট এবং টি-২০ ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০১৪ সালের বোলিংয়ে নিষিদ্ধর ঘটনা ছাড়া তেমন কিছু গ্রাস করতে পারেনি তাকে! তবে, তিনি গ্রাস করেছেন বিপক্ষ দলের ক্রিকেটারদের।

ওয়ানডে ক্রিকেটের শুরুটা বাজে হলেও টেস্ট ক্রিকেটের শুরুটা ছিলল রাজকীয় ভাবেই। আহমেদাবাদের সরদার প্যাটেল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচে ভারতের সেরা স্পিনারদের বিপক্ষে যখন দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা সাজঘরে ফিরছেন তখন মাটি কামড়িয়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন উইলিয়ামসন। নিজের অভিষেক ম্যাচে খেলেন ২৯৯ বলে ১৩১ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। আর এতেই নিউজিল্যান্ডের পক্ষে ৮ম ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন তিনি।

—–

একজন উইলিয়ামসনকে আপনি কতোটা জানেন? আপনি কি জানেন! বর্তমান ক্রিকেটের ভিন্ন এক চরিত্র নিউজিল্যান্ডের এই গ্রেট ক্রিকেটার? আসুন আমিই বলি কি কারণে তাকে ভিন্ন বা ব্যতিক্রমী চরিত্রের অধিকারী বলা হয়।

বিপক্ষ দলের দুইজন সেট ব্যাটসম্যান নিজেদের সাবলীল খেলা খেলে যাচ্ছেন! সেই সাথে গড়ছে রানের পাহাড়। আরেকদিকে অধিনায়ক উইলিয়ামসন নিরব ভূমিকায়। বোলারের কাছে তেমন আসা যাওয়াও নেই; মনে হয় তিনি ক্রিকেটের মাঠের একজন সন্ন্যাসী। আসলেই তাই! বর্তমান ক্রিকেটে যেখানে দলের কোনো প্লেয়ার বাজে পারফর্ম বা কোনো ভুল করলে মাঠেই মেজাজ হারিয়ে বসে অধিনায়করা। সেখানে ব্যতিক্রমী কেন উইলিয়ামসন। তাকে দেখলে মনে হয় মাঠে প্রতিজ্ঞা করেই নেমেছে! তাই যে যার মতো চলে চলতে থাকুক।

আবার দল ঘোর বিপদে! দলের সিনিয়র বা টপ ব্যাটসম্যানরা হতাশ করেছে। সেখানেই যে ব্যাট হাতে দলকে মেরামতের কাজটা তাকেই করতে হবে। এখানেও সফল তিনি, ঠান্ডা মাথায় ক্লাসিক সব শটস খেলে বাড়িয়ে নেন দলের রান, নিজের নামটি তুলতে থাকেন উপরের দিকে। সেই সাথে কখনোবা ব্যাট হাতে ম্যাচ জয়ী ছক্কা হাঁকিয়েও নিরব ভঙ্গিতে উদযাপন। মনে হয় তার উদযাপনে কোনো মাথাব্যথাই নেই। আর থাকবেই বা কি করে! এইসব উদযাপনে যে ছোট বেলা থেকেই তার অনীহা।

এভাবেই চলছে একজন কেন উইলিয়ামসন। চলছে নিজ গতিতে; যেখানে তাকে ডাকছে নিউজিল্যান্ডের গ্রেট ক্রিকেটাররা। আর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নীরবে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য এক উচতায়। যেখানে খুব তাড়াতাড়ি সাবেকদের পিছিয়ে ফেলতেও পারেন তিনি।

আজকের গল্পের শেষটা করতে চাই ক্রিকেট মাঠে উইলিয়ামসের কিছু জানা অজানা রেকর্ড আর কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে:

  • টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করা ১০৬ জন ব্যাটসম্যানের একজন কেন উইলিয়ামসন।
  • সাদা পোশাক এবং রঙ্গিন পোশাকে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ১০০০+ রান করা ক্রিকেটার উইলিয়ামসন।
  • উইলিয়ামসনের এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ৫ টি টেস্ট সেঞ্চুরি রয়েছে।
  • টেস্ট ক্রিকেটে ৯ টি দেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা ১৩ ক্রিকেটারের একজন তিনি।
  • সাদা পোশাকের ক্রিকেটে নির্দিষ্ট মাঠে রয়েছে ১০০০+ রানের রেকর্ড।
  • ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে দ্রুততম ৫০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করার তালিকায় রয়েছে ৯ নাম্বারে। নিউজিল্যান্ডে পক্ষে দ্রুততম।
  • অধিনায়ক হিসেবে ৯ টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির মালিক উইলিয়ামসন। যা নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সর্বোচ্চ।
  • টি-২০ ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে দ্রুততম ১০০০ রানের মালিক উইলিয়ামসন।
  • টি-২০ ক্রিকেটে মার্টিন গাপটিলের সাথে ওপেনিং জুটিতে তুলেছেন ১৭১ রান। যা নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সর্বোচ্চ এবং সব মিলিয়ে রয়েছে ৩ নাম্বারে।

এমন অনেক রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে আছে উইলিয়ামসন। দেশের পক্ষে এমন কিছু করেছেন যা তাকে দিয়েছে ‘ওয়ান ম্যান আর্মির’ খেতাব। দিনশেষে পাওয় – না পাওয়ার হিসেবি যুগে যেটা পেয়েছেন সেটাই তাকে নিয়েছেন গ্রেটদের সারিতে। একজন উইলিয়ামসনকে অনেক জানলাম, কিন্তু একজন অধিনায়ক উইলিয়ামসন কেমন ছিলো! এই প্রশ্নের উত্তরটা কেমন হবে? এবার আসুন সেই উত্তর খুঁজি:

উইলিয়ামসন; নিউজিল্যান্ডে জার্সিতে সাদা পোশাকের ৮০ ম্যাচে সংগ্রহ করেছেন ৬৪৭৬ রান। ওয়ানডে ক্রিকেটের ১৫১ ম্যাচে করেছেন ৬১৭৪ রান এবং টি-২০ ক্রিকেটের ৬০ ম্যাচে ঝুলিতে ১৬৬৫ রান!

এই ছিলো একজন ক্রিকেটার উইলিয়ামসনের ব্যাটিং পরিসংখ্যান। এবার জানবো একজন অধিনায়ক উইলিয়ামসনের পরিসংখ্যান গুলো।

সাদা পোশাকের ৩২ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন উইলিয়ামসন। যেখানে ১৮ জয়ের বিপরীতে হেরেছেন ৮ ম্যাচে। এই ৩২ ম্যাচে ৫৪.২০ গড়ে রান করেছেন ২৪৩৯। যেখানে তার পুরো টেস্ট ক্যারিয়ারের ব্যাটিং গড় ৫০.৯৯!

ওয়ানডে ক্রিকেটে ৭৮ ম্যাচে ক্যাপ্টেন্সি করেছেন কেন। যেখানে ৪২ জয়ের বিপরীতে হেরেছেন ৩৪ ম্যাচে। এই ৭৮ ম্যাচে ৪৯.২৩ গড়ে করেছেন ৩৪৪৬ রান! যেখানে তার ক্যারিয়ারে ব্যাটিং গড় ৪৭.৪৮!

টি-২০ ক্রিকেটেও অধিনায়ক হিসেবে খেলেছেন ৪২ ম্যাচ। যেখানে ১৯ জয়ের বিপরীতে হেরেছেন ২২ ম্যাচে। এই ৪২ ম্যাচে ৩২.৭১ গড়ে নামের পাশে যুক্ত করেছেন ১২৪৩ রান। যেখানে তার টি-২০ ক্যারিয়ারে মোট রান ১৬৬৫!

উপরের পরিসংখ্যান দেখে বলায় যায় অধিনায়ক হিসেবে সফল একজন কেন উইলিয়ামসন। এই উইলিয়ামসন তিন ফরম্যাট মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সবচেয়ে বেশী ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এবং নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সবচেয়ে বেশী ম্যাচ জয়ী অধিনায়কও তিনি।

সবমিলিয়ে বলা যায় বর্তমান ক্রিকেটের ব্যক্তিক্রমী চরিত্র কেন উইলিয়ামসন একজন পারফেক্ট ক্রিকেটার। একজন পারফেক্ট এবং সফল অধিনায়ক। সেই ৩ বছরে ব্যাট হাতে তুলে নেওয়া কেন উইলিয়ামসন আজ বিশ্বের সেরাদের একজন। আর এই সেরা ক্রিকেটারের আজ জন্মদিন। ১৯৯০ সালের আজকের দিনে নিউজিল্যান্ডের তৌরাঙ্গা, বে অব প্লেন্টি নামক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আজকের এই শুভ দিনে উইলিয়ামসনকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

শুভ জন্মদিন কেন উইলিয়ামসন।

,

মতামত জানান :