১৬ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

অরণ্য; নড়াইলের নতুন সূর্য!

প্রতিবেদক
Arfin Rupok
শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারি , ২০২১ ৮:৫৬

ব্যাডমিন্টনে হয়েছেন তিনি তিনবার জেলা চ্যাম্পিয়ন! সেই ছেলেটির তো বাংলাদেশের হয়ে ব্যাডমিন্টন মাতানোর কথা। কিন্তু সে এখন ক্রিকেটার; একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। বলছি নড়াইলে জন্ম নেওয়া সূর্যের কথা। যেই সূর্য ইতিমধ্যেই কিরণ ছড়িয়েছেন বিশ্বমঞ্চে।

নড়াইল; নামটির কথা মনে হলেই ভেসে ওঠে চিত্রা নদীতে সাঁতার কেটে বড় হওয়া ২২ গজের এক লড়াকু যোদ্ধার নাম। কতোবার ছুরির নিচে গিয়েও ফিরেছেন নতুন ভাবে; করেছেন রেকর্ড; লিখেছেন ইতিহাস! তবে আজকের গল্পটি সেই যোদ্ধাকে নিয়ে নয়, গল্পটি একজন চ্যাম্পিয়নের। আর এই চ্যাম্পিয়নের নাম অভিষেক দাস অরণ্য।

অরণ্য; ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। ছোট বেলায় দেখতেন নড়াইলেই একজন পেসার ২২ গজে বোলিং ঝড় তুলে শিকার করতেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের। সেই মানুষটির খেলা দেখে আগ্রহ বাড়ে ক্রিকেটের প্রতি; টেপটেনিসে শুরু হলো ক্রিকেট দীক্ষা। এইসব নিয়ে ধাপে ধাপে আলোচনা করবো। এখন জানবো অরণ্যের শুরুর গল্পগুলো…

জন্মস্থান এবং বেড়েওঠা:
৫-ই সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে নড়াইলে জন্ম হয় এক ফুটফুটে শিশুর। বাবা-মা আদর করে ছেলেটির নাম রেখেছিলেন অভিষেক দাস। কিন্তু পরিবারের সবাই তাকে আদর করে অরণ্য বলে ডাকতেন। নড়াইলে জন্ম নেওয়া ছোট্ট অরণ্য বড় হত থাকে পরিবারের সবার ভালোবাসায়। এভাবেই বেড়ে উঠতে থাকেন তাদের অরণ্য। ছোট বেলায় মাশরাফির খেলা দেখে বড় হওয়া অরণ্য ব্যাডমিন্টনেই মনোযোগী ছিলেন বেশী। ছোট্ট বেলায় ক্রিকেটকে বেছে না নিলেও এখন তিনি একজন চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার।

ক্রিকেটে আগমন:
সময়টা ২০১২ সাল; ব্যাডমিন্ট টুর্নামেন্ট মাতাতে গেলে অরণ্যের বাবার বন্ধুর চোখে পড়ে এক লম্বাদেহী কিশোর। সেদিন স্হানীয় কোচ সৈয়দ মনজুর তৌহিদের চোখে পড়েন অরণ্য। আর সেদিন থেকেই শুরু হয় অরণ্যের নতুন জীবন। শুরু হয় ক্রিকেটের পথচলা।

প্রথম কোচ:
অরণ্যের শুরুটা তুহিন স্যারের ক্লাবে। আর প্রথম কোচ ছিলেন নড়াইলের সঞ্জীব বিশ্বাস সাজু। সাজুর হাত ধরেই ক্রিকেটের পথচলা শুরু হয় অভিষেকের। সেখানে নিজেকে ঝালিয়ে নেন অরণ্য। পরবর্তী সময়ে অনেক কোচের অধিনে ক্রিকেট দীক্ষা নিলেও তুহিন স্যারকে কখনোই ভুলবেন না অভিষেক দাস।

পড়াশোনা:
ক্রিকেট মাঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও পড়াশোনায় পিছিয়ে নেই অরণ্য। পড়াশোনাকে আঁকড়ে ধরে বড় হওয়া অরণ্য ইতিমধ্যেই এইচএসসি পাস করেছেন। ক্রিকেট, পড়াশোনা, ব্যাডমিন্টন; এভাবেই এগিয়ে নিয়েছেন অভিষেক দাস।

যেখানে শুরু অরণ্যের ক্রিকেটীয় ইনিংস:
বাবার বন্ধুর হাত ধরে ক্রিকেটে পা রাখা অরণ্যের দ্বিতীয় ঘর হয়ে উঠেছিলো বেসিক ক্রিকেট ক্লিনিক। কেননা এই ক্লাবেই শুরু হয়েছিলো অরণ্যের নতুন ইনিংস। এখানে বেশকিছু দিন ঝালিয়ে নেওয়া অরণ্য এখন উদয়াচল ক্লাবের ছাত্র। যেখানে পড়াশোনা এবং ক্রিকেট; সবকিছুতেই ঝালিয়ে নিচ্ছেন এই ডানহাতি পেসার।

অভিষেক দাসের ক্রিকেটে আসার পেছনে তৌহিদ স্যার ছাড়াও আরেকজন মানুষের ভূমিকা রয়েছে। যেই মানুষটি নড়াইলের নাম ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বের সামনে। তিনি মাশরাফি বিন মর্তুজা। ছোট বেলা থেকেই মাশরাফিকে আইডল মানা অভিষেক দাস মাশরাফির কথায় পেয়েছিলেন অনুপ্রেরণা। যা তাকে বিশ্বসেরা বানিয়ে দিয়েছে। এইসব নিয়ে রয়েছে অনেে গল্প; এইসব না হয় অন্য একদিন আলোচনা করবো। এবার জানতে থাকি লাল-সবুজের জার্সিতে অরণ্যের শুরুর গল্প এবং ক্রিকেট মাঠে তার পারফর্ম গুলো:

২০১২ সালে নড়াইল জেলার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৪ দলে অভিষেক হয় অভিষেক দাসের। সেই পথচলায় পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সময়ের সাথে সাথে খেলেছেন বয়সভিত্তিক নানান দলে। অভিষেক দাসের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিলো খুলনা জেলা অ-১৫ দলের হয়ে খেলতে পারাটা। কেননা ঐ অ-১৫ দলে ভালো পারফর্ম করেই নজরে আসেন তিনি। জায়গা হয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলে। এখানে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে না পারলেও নড়াইল অ-১৮ দলের হয়ে খেলার সময় ডাক পান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের চ্যালেঞ্জ সিরিজে। আর সেই ম্যাচে ৩ উইকেট শিকার করে নজরে আসেন, জায়গা করে নেন বাংলাদেশ অ-১৯ দলে।

১ অক্টোবর ২০১৮ সাল; অভিষেকের জন্য ছিলো স্মরণীয় একটি দিন। এই দিন অ-১৯ দলের হয়ে লাল-সবুজের জার্সিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক হয় তার। অভিষেক ম্যাচে বল হাতে ১ উইকেট এবং ব্যাট হাতে অপরাজিত ছিলেন ৪ রানে। এরপর অ-১৯ দলে খেলেছেন বেশকিছু ম্যাচ। বাকি প্লেয়ারদের পারফরম্যান্স ভালো হওয়ায় খুববেশী ম্যাচ খেলার সুযোগ না হলেও সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন এই অলরাউন্ডার।

অ-১৯ দলের হয়ে ১১ ম্যাচে ৪২.০০ গড়ে করেছেন ১২৬ রান এবং বল হাতে শিকার করেছেন ১৫ উইকেট।

বিভিন্ন দলের বিপক্ষে অভিষেকের পারফরম্যান্স:
ইংল্যান্ড: ১ ম্যাচ – ৬ রান – ১ উইকেট।
ভারত: ২ ম্যাচ – ৫ রান – ৬ উইকেট।
নিউজিল্যান্ড: ৩ ম্যাচ – ৬১ রান – ৪ উইকেট।
পাকিস্তান: ৩ ম্যাচ – ২৪ রান – ১ উইকেট।
শ্রীলঙ্কা: ৩ ম্যাচ – ৩০ রান – ৩ উইকেট।

বিভিন্ন দেশে অভিষেকের পারফরম্যান্স:
বাংলাদেশ: ৪ ম্যাচ – ৩৪ রান – ৪ উইকেট।
ইংল্যান্ড: ২ ম্যাচ – ৬ রান – ৪ উইকেট।
নিউজিল্যান্ড: ৩ ম্যাচ – ৬১ রান – ৪ উইকেট।
দক্ষিণ আফ্রিকা: ২ ম্যাচ – ২৫ রান – ৩ উইকেট।

হোম সিরিজে ৪, আওয়ে সিরিজে ৫ উইকেট শিকার করা অভিষেক দাস নিরপেক্ষ মাঠে শিকার করেছেন ৬ উইকেট।

অধিনায়ক আকবরের অধিনে ১০ ম্যাচে ১২২ রানের সাথে ১৪ উইকেট শিকার করা অভিষেক তৌহিদ হৃদয়ের অধিনে ১ ম্যাচে ৪ রানের পাশাপাশি বল হাতে শিকার করেছেন ১ উইকেট।

অ-১৯ দল ছাড়াও লিস্ট এ ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে তার। লিস্ট এ ক্রিকেটে ১ ম্যাচে ১৪ রানের পাশাপাশি বল হাতে শিকার করেছেন ৩ উইকেট।

অভিষেক দাস; মূলত বোলিং অলরাউন্ডার। ৬ ফুট উচ্চতার এই ডানহাতি পেসার আউটসুইংয়ে পরাস্ত করেন ব্যাটসম্যানদের। সেই সাথে ব্যাট হাতে ফিনিশিংয়েও দলকে দারুণ কিছু উপহার দিয়েছেন। ১৩০+ গতিতে বল করা এই ক্রিকেটার ব্যাট হাতে দ্রুত রান তুলতে পারদর্শী।

অভিষেক দাস ইতিমধ্যেই অ-১৯ ক্রিকেটে প্রমাণ করেছেন নিজেকে। বিশ্বমঞ্চের ফাইনালে জাত চিনিয়িলেন; বল হাতে শিকার করেছিলেন ৩ উইকেট। শুধু তাই না! সেদিন তার ৩ টি উইকেট ছিলো অনেক মূল্যবান। এছাড়াও নিউজিল্যান্ড সফরে খেলেছিলেন ৪৮ রানের অপরাজিত এক ইনিংস।

অভিষেদ দাস; বাংলাদেশের তরুণ উদীয়মান পেস অলরাউন্ডার। বেন স্টোকস এবং মাশরাফিকে আইডল মানা এই ক্রিকেটার কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে আবারো বিশ্বমঞ্চের ফাইনালে লাল-সবুজের ৩৩ নাম্বার জার্সিতে ডানহাতে প্রিয় পুল শটে একের পর এক বাউন্ডারি মারবে আবার কখনোবা ৬ ফুটের লম্বাটে শরীর নিয়ে ছুটে এসে ২২ গজে দুর্দান্ত আউটসুইংয়ে তুলে নিয়ে পতিপক্ষের উইকেট! তখন নড়াইল শহরের বড় কোনো পর্দার সামনে ভীড় করবে হাজরো জনতা! আর মাঠে বসে অরণ্যেই সেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স উপভোগ করবেন মাশরাফি! আর হয়তো মনে মনে বলবে ‘সাব্বাশ অরণ্য; আমি নড়াইলকে যা করে দেখাতে পারিনি সেটা তুই করে দেখিয়ে দিলি!’

এইসব কল্পনা; এই কল্পনাগুলো বাস্তবে পরিণত করতে হবে অভিষেক দাসকে। সেই দিনের অপেক্ষায়। শুভ কামনা রইল বাংলাদেশের তরুণ উদীয়মান অলরাউন্ডার অরণ্যের জন্য।

,

মতামত জানান :