“স্পোর্টস ডিপ্লোম্যাসি” বা ক্রীড়া কূটনীতি তথা রাজনৈতিক চর্চার ইতিহাস গ্রেটেস্ট শো অফ অলটাইম “অলিম্পিক” থেকে শুরু করে হালের ক্রিকেটে সুবিশাল বিস্তার অর্ধশতাধিক বা তারও বেশি দশকের পুরনো। আর ক্রিকেট ইতিহাসের এই পাতার সর্বশেষ সংযোজন ২০২৫ এশিয়া কাপের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তানের সব শেষ মুখোমুখি লড়াই।
বন্দুক ও ০-৬ (২০২৫):
২১শে সেপ্টেম্বর,২০২৫ দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে রাজনৈতিক উত্তাপের বহিঃপ্রকাশ শুরু হয় পাকিস্তানি ব্যটসম্যান সাহিবজাদা ফারহানের অর্ধশতক হাঁকানোর পর উদযাপনের মধ্য দিয়ে। যেখানে ব্যাট হাতে রাইফেল চালানোর ভঙ্গিমায় ফারহানকে এই অর্জন উৎযাপন করতে দেখা যায়।
তবে মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এদিন ছিলেন পাকিস্তানি পেসার হারিস রউফ যিনি বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করার সময় ভারতীয় সমর্থকদের দুয়োধ্বনির জবাবে প্লেন ক্রাশ এবং হাত দেখিয়ে ০-৬ এর ইঙ্গিত করেন। এরপর আর বুঝতে বাকি থাকে না তিনি মূলত কোন ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
২২শে এপ্রিল, কাশ্মীরে পেহেলগাম হামলার প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া উত্তেজনা এবং এর পরবর্তীতে ৭ই মে, ২০২৫ ভারতের “অপারেশন সিন্দুর” এবং ১০ই মে, পাকিস্তানের পাল্টা জবাবে সংঘটিত হামলা “অপারেশন বুনিয়ান-ই-মারসুস” যা ভারতের ৬টি রাফালে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবী করে। পক্ষান্তরে, নিজেদের যুদ্ধবিমানের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা শূন্য দাবী করে পাকিস্তান। আর ভারত-পাকিস্তান দুই চিরশত্রুর যুদ্ধে পাকিস্তানের দাবি করা জয়েরই বহিঃপ্রকাশ ক্রিকেট মাঠে ঘটিয়েছেন হারিস রউফ।
ক্রিকেট ইতিহাসে এই ধরনের রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি এটিই প্রথম নয়। ঐতিহাসিক আরও কয়েকটি ক্রিকেটীয় রাজনৈতিক উত্তাপ নিয়ে সাজানো আমাদের এই বিশেষ নিবেদনের শুরুতেই রয়েছে,
দ্যা নিউল্যান্ড ওয়াক-অফ(১৯৭১):
১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নিপীড়ন যখন তুঙ্গে, তখন সে অগ্নিকুণ্ড ছড়িয়ে পড়ে দেশটির ক্রিকেট অঙ্গনেও। ৩রা এপ্রিল, ১৯৭১ সালে “রেস্ট অফ সাউথ আফ্রিকা” একাদশের বিপক্ষে মাঠে নামে কুরি কাপ চ্যাম্পিয়ন “ট্রান্সভাল”। যে ম্যাচ ঘিরে রীতিমতো চাঁদের হাট বসে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের নিউল্যান্ডসে।
যেখানে ট্রান্সভিলের নেতৃত্বে ছিলেন ডোনাল্ড ম্যাকি কগহিল এবং ওপেনিংয়ে ছিলেন ব্যারি রিচার্ডস ও ক্লাইভ রাইস। অন্যদিকে, রেস্ট অফ সাউথ আফ্রিকা একাদশের নেতৃত্বে ছিলেন কিংবদন্তী গ্রায়েম পলক এবং দলে আরও ছিলেন, মাইক প্রক্টর, ভিনসেন্ট ভ্যান ডের বিজেল, পিটার পলক, হিল্টন এ্যাকেরম্যান, ডেনিস লিন্ডসের মত তারকারা।
যেটি মূলত ছিল একই বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিতব্য অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সেরা একাদশ নির্বাচনের উদ্দেশ্যে একটি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ।
অথচ ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইনিংসের প্রথম বল মাঠে গড়ানোর পরপরই উভয় দলের সকল ক্রিকেটার ওয়াক অফ করে মাঠ ত্যাগের মাধ্যমে এক ভিন্নধর্মী প্রতিবাদের নজির স্থাপন করেন।
কারণ এই ম্যাচ শুরুর ঠিক আগেরদিন দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন জানায়, অস্ট্রেলিয়া সফরের উদ্দেশ্যে দুইজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে দলে নেওয়ার যে আবেদন করে তারা তা নাকচ করে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন সরকার। যদিও ওয়াকআউটের কিছুক্ষণ পরেই উভয় দলের ক্রিকেটাররা মাঠে ফেরেন এবং পরবর্তীতে ঐ ম্যাচ ড্র হয়। তবুও সেসময় বর্ণবাদের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের এই দৃঢ় অবস্থান জায়গা করে নেয় ইতিহাসের সংগ্রামী পাতায়।
ব্ল্যাক আর্মব্যান্ড প্রোটেস্ট (২০০৩):
এবারের ঘটনা একেবারে বিশ্বমঞ্চের। ২০০৩ ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ, দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি আয়োজক দেশ হিসাবে প্রথম ও শেষবারের মতো নাম লেখায় জিম্বাবুয়ে। তখনও ক্রিকেট বিশ্বে জিম্বাবুয়ের স্বর্ণালী যুগ প্রবাহমান কিন্তু দেশ হিসাবে অবস্থা শোচনীয় প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের স্বৈরাচারী শাসনে অতিষ্ঠ দেশটির জনগণ, শ্বেতাঙ্গরাও চরম নিপীড়িত। ঠিক তখন ত্রাতা হিসাবে অবির্ভূত হন দুই জিম্বাবুয়ান ক্রিকেটার অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা। ১০ই মার্চ, ২০০৩ বিশ্বকাপের জিম্বাবুয়ে পর্বের প্রথম ম্যাচে হারারেতে নামিবিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামে স্বাগতিক জিম্বাবুয়ে। কিন্তু পরিকল্পনা চলতে থাকে এই ঘটনার এক মাস আগে থেকে জিম্বাবুয়ের এক রেস্টুরেন্টে। তবে ম্যাচ ডে তে ছিলো শুধু আনুষ্ঠানিকতা। যদিও তার আগে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পৌঁছে গেছে সংবাদ মাধ্যমে, রবার্ট মুগাবের বিরুদ্ধে “গণতন্ত্র হত্যার প্রতিবাদ” মর্মে এবং জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ডের কর্তাদের সাথে নানারকম বাদানুবাদের পর সবকিছু উপেক্ষা করে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা কালো আর্ম-ব্যান্ড পরে সারা বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন বিশ্বকাপে। সেই সাথে তুলে ধরেন দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে যা উজ্জীবিত করে সাধারণ মানুষকে।
কিন্তু এই ঘটনার ফলশ্রুতিতে সেসময়ে আর দেশে ফেরা হয়নি এই দুই ক্রিকেটারের। যেখানে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার দলে থাকলেও উপেক্ষিত বোধ করেন এবং হেনরি ওলোঙ্গাকে অফ ফর্মের অজুহাতে দল থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং বিশ্বকাপ শেষেই জিম্বাবুয়ে জাতীয় দল থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। পরবর্তীতে এই দুইজন ক্রিকেটারই ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান।
ফ্রি প্যালেস্টাইন;সেইভ গাজা (২০১৪):
২৮শে জুলাই, ২০১৪ সাউদাম্পটনে ভারতের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের ৩য় টেস্টের ২য় দিনে রিস্ট ব্যান্ড পরে খেলতে নামলেন ২৭ বছর বয়সী পাকিস্তানি বংশদ্ভূত ইংরেজ ক্রিকেটার মঈন আলী। রিস্ট ব্যান্ডে লেখা ছিল “ফ্রি প্যালেস্টাইন”, “সেইভ গাজা”। যা সে মাসের শুরুর দিকে ফিলিস্তিনের গাজায়, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ ছিল মঈনের। আর এই ঘটনার জের ধরে আইসিসি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে রিস্টব্যান্ড পরার ক্ষেত্রে মঈন আলীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কারণ বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার মতে, ক্রিকেট মাঠে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এমন আচরণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
সেনাবাহিনীর ক্যাপ কাণ্ড (২০১৯):
এবারের প্রেক্ষাপট ৬ বছর আগের ভালোবাসা দিবসের অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সালের ঘটনা। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের মতো একটি দিনেও “চিরশত্রু ” শব্দটার মান রাখতেই বোধহয় পাকিস্তানি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালালো ভারত অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা অঞ্চলে। যে হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হন। যে ঘটনার পাল্টা জবাব দেয় ভারত, পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে আক্রমণের মাধ্যমে।
তবে এই যুদ্ধাবস্থার দাবানল ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেট মাঠে ঘটনার ২২ দিন পার করার পরও। ৮ই মার্চ, ২০১৯ অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফরের সময় ওয়ানডে সিরিজের ৩য় ম্যাচে মাহেন্দ্রা সিং ধোনির নেপথ্য নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সকল সদস্য অজিদের বিপক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ পরে মাঠে নামেন পুলওয়ামায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমবেদনা জানাতে। অথচ এই ঘটনার ঠিক পরের দিন পাকিস্তান খেলার মাঠে রাজনীতি আনার অভিযোগে আইসিসিকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বললেও তারা কর্ণপাত করেনি।
যদিও একই বছর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিজেদের ম্যাচে ভারতীয় ক্রিকেটার ও সেদেশের সেনাবাহিনীর অবৈতনিক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল. মাহেন্দ্রা সিং ধোনি তার প্যারাট্রুপার রেজিমেন্টের সামরিক চিহ্ন খচিত উইকেট কিপিং গ্লাভস পরার জন্য আইসিসি থেকে সতর্ক বার্তা পান।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (২০২০):
করোনা মহামারির ধকল সামলে দীর্ঘ ১১৭ দিন পর উইন্ডিজের ইংল্যান্ড সফরে মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রত্যাবর্তন হয় ২২ গজে। তখন বিশ্বব্যপী সকলে সোচ্চার আমেরিকার যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে নিয়ে। যাকে হাঁটু দিয়ে গলা চেপে ধরে নৃশংসভাবে হত্যা করে মিনিয়াপোলিসের শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চৌভিন। আর এরপর থেকে আগ্নেয়গিরির স্ফুলিঙ্গের মতো “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” বা কৃষ্ণাঙ্গরাও মানুষ শীর্ষক আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়ে।
আর এই আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়েই ৮ই জুলাই, ২০২০ সাউদাম্পটনে সিরিজের প্রথম টেস্ট শুরুর আগে ইংল্যান্ড ও উইন্ডিজ দলের ক্রিকেটাররা এমনকি আম্পায়ারও মাঠে হাঁটু গেঁড়ে জর্জ ফ্লয়েডের স্মরণে শদ্ধা নিবেদন করেন।
এমনকি ২০২২ সালেও একই ঘটনার প্রতিবাদ ও আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পার্থ টেস্টে উইন্ডিজের বিপক্ষে প্যাট কামিন্সের নেতৃত্বাধীন অজি ক্রিকেটাররা মাঠে হাঁটু গেঁড়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাদের জোরালো অবস্থান বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন।
স্বাধীনতা একটি মানবাধিকার; সকল জীবন সমান(২০২৩):
১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৩ পাকিস্তানের অস্ট্রেলিয়া সফরে সিরিজের প্রথম টেস্টে অজি ওপেনার উসমান খাজার জুতোয় টেপ দেখা গেলো আর হাতে আর্মব্যান্ড। মূলত সে বছরের ৭ই অক্টোবর থেকে অদ্যাবধি ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে ইসরাইলের চালানো নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে উসমান খাজা তার পায়ের জুতায় লেখা “স্বাধীনতা একটি মানবাধিকার” এবং “সকল জীবন সমান” কথা দুটিকে এই পাশবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে বেছে নেন। কিন্তু আইসিসির বিরোধিতায় শেষমেষ টেপ বেঁধে জুতায় লেখা প্রতিবাদ ঢাকা হলেও থামানো যায়নি উসমান খাজাকে। তিনি কালো আর্মব্যান্ড পরেই মাঠে নেমে গেলেন ঐ টেস্টে।
২৬শে ডিসেম্বর বক্সিং ডে টেস্টে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে মেলবোর্নে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে শান্তির প্রতীক কবুতর ও জলপাই পাতার চিহ্ন সম্বলিত জুতা পরে এবার খেলতে চান উসমান খাজা। কিন্তু আবারও বাঁধ সাধে আইসিসি। শেষে নিজের দুই মেয়ের নাম জুতায় লিখে ফিলিস্তিনে নিহত শিশুদের স্মরণ করে প্রতিবাদ জানান খাজা। পরবর্তীতে সেই জুতা নিলামে তুলে প্রাপ্ত সব অর্থ ফিলিস্তিনিদের সাহায্য দান করেন খাজা।
এমনকি ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার শ্রীলঙ্কা সফর চলাকালীন অজি রিপোর্টার পিটার লারোরের ফিলিস্তিন সম্পর্কিত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে তাকে চাকরিচ্যুত করার পর এই ক্রীড়া সাংবাদিকের পাশে দাঁড়ান উসমান খাজা এবং তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করেন।
পরিশেষে মাঠের ক্রিকেট মাঠেই থাকা প্রত্যাশিত। তবে প্রশ্ন যখন চলে আসে নিজের দেশ, জাতি বা মানবিকতার তখন হয়তো গ্রায়েম পলক, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার বা উসমান খাজারা মনুষ্যত্বের কাতারে সামনে সারিতে থেকেই আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখান পরবর্তী প্রজন্মকে।